বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়েছে জমির উপরিভাগে। দেখা দিয়েছে দীর্ঘ খরা। বরেন্দ্র অঞ্চলে অতিরিক্ত নলকূপনির্ভরতা এবং পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে এখন কৃষি, বসতভিটা ও দৈনন্দিন জীবনে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি সরকার নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সেচ কিংবা শিল্পকারখানার জন্য আর গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ভূগর্ভস্থ পানি তোলাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কৃষকদের সরবরাহ করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১৮ হাজার গভীর নলকূপ আছে। গত সপ্তাহে সরকারের এ-সংক্রান্ত গেজেট তাদের হাতে পৌঁছায়। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতি বছর আনুমানিক ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, যা মূলত বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) পরিচালিত গভীর নলকূপ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। এ অঞ্চলটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের একটি প্রধান কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী এলাকা, যা দেশের মোট সেচকৃত বোরো ধানের প্রায় ৩৫ ভাগ এবং গমের ৬০ ভাগ সরবরাহ করে। বরেন্দ্র অঞ্চলে দীর্ঘদিন করে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন উন্নয়নকর্মী আরিফ ইথার। তিনি বলেন, একসময় যা এক ফসলি জমি ছিল, তা এখন সেচ সুবিধার কারণে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ধান ও গম ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আম, পেয়ারা, কমলা, মাল্টা, সবজি, মসলা, ডাল এবং তেলবীজসহ অন্যান্য বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসল চাষে কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন। বরেন্দ্র অঞ্চল দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এখন হঠাৎ করেই পানি সরবরাহ বন্ধ হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্যভান্ডারে।
পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বরেন্দ্রে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বিকল্প উৎস ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। তাদের মতে, বর্ষার পানি সংরক্ষণই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। বাড়ি, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রাম পর্যায়ে ছাদের পানি সংগ্রহ, পুকুর-দিঘি ও বিল পুনঃখনন এবং খাল-নালার সংযোগ পুনরুদ্ধার করলে সারা বছর সেচ ও গৃহস্থালির কাজে পানি পাওয়া সম্ভব।
অ্যাসেডোর নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ রবিউল ইসলাম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন। এখানে সব কৃষক গভীর নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করা যেমন জরুরি, তেমনি কৃষকদের জন্য পানির ব্যবস্থা করাও জরুরি। সরকার পানি কৃষিকাজে ব্যবহার বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারির আগে এ অঞ্চলের কৃষকদের মতামত নিলে ভালো হতো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে পুকুর-দিঘি ঐতিহ্যের অংশ ছিল। এখন সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। জলাধার পুনঃখনন করলে শুধু সেচেই নয়, ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জও বাড়বে।’ তিনি বলেন, বিকল্প উৎস তৈরি না করে গভীর নলকূপের পানি কৃষিকাজে ব্যবহার বন্ধ করলে শস্য উৎপাদনে তার নেতিক প্রভাব পড়বে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, নলকূপের ওপর নির্ভরতা কমাতে তারা বিকল্প উৎস চান। কৃষক সোহরাব আলী বলেন, ‘এখন পানি না পেলে আমরা ফসল করব কীভাবে? আগে তো বিকল্প পানির ব্যবস্থা করতে হবে।’ বিএমডিএর সেচ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ জিল্লুল বারী জানান, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে কৃষিকাজ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। এখন এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিষয়। তারা বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’