দিনের পর দিন দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে কমে যাচ্ছে মুক্ত জলাশয়ের মৎস্যসম্পদ। গত এক দশকে বিভিন্ন ধরনের ৫৪ প্রজাতির মাছের নাম এসেছে বিলুপ্তির তালিকায়। সংকট নিরসনে হ্যাচারীতে মৎস্য প্রজনন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। কিন্তু মুক্ত জলাশয়ের প্রাকৃতিক মাছের প্রজাতি সংরক্ষণে বিজ্ঞান ভিত্তিক টেকসই প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে না। কার্প জাতীয় ২১ প্রজাতির নতুন মাছ বাজার দখল করলেও, ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালির ঐতিহ্য’ কেবল পহেলা বৈশাখেই সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রতি অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও দেশীয় মাছের অভাবে বিদেশের মূল্যবান অর্থনীতিতে অধিকতর অর্জনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না।
দেশি জাত হারিয়ে যাওয়ার ১৫টি কারণ উল্লেখ করেছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো- জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলের জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদীর নব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট হওয়া, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, মা মাছের ডিম ছাড়ার আগেই ধরে ফেলা, ডোবা-নালা পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ, মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো এবং খালে, বিলে ও পুকুরে নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা।
কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মিঠা পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এক সময় এ দেশের খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ও নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশি মাছে। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন দেশীয় প্রজাতির মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সূত্রমতে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকেম চোরাকারবারীরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল এনে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয়াঞ্চলের হাট বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করে থাকে। কিছু অসাধু মৎস্য শিকারীরা তা কিনে সুন্দরবনসহ নদী-খাল-বিলে এবং অভয়ারন্য এলাকা থেকে মাছের পোনা শিকার করে। এতে প্রতিটি নেট চেকিং এ কয়েক কোটি রেনু পোনা বা ভাতি পোনা ধ্বংস হয়। এসব কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার দারুনভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে উপকূলীয়ঞ্চলের নদ-নদী, খাল, বিল ও সুন্দরবন। দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ। আর সুন্দরবন উপকূলীয়ঞ্চল থেকে মোট মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন ৪১ শতাংশ।
দেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুঁজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারাবাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৬৪টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর মধ্যে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাম ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় চার ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রফতানি আয়ে মৎস্যখাতের শরিকানা শতকরা প্রায় চার ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং এক কোটি ৪০ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে।