বাংলাদেশের মতোই ওই দুটি দেশে ‘জেন জি’ নেতৃত্বের আন্দোলনে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটেছিল। কয়েক দিন আগে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকেও এই বিষয়টি তুলে ধরেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। তাছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন পর্যায়ে এই বার্তাটি ঢাকার কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদন
বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লড়ার আর কোনও সুযোগ পাচ্ছে না বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভারত এ বিষয়ে এখনও পুরোপুরি হাল ছাড়েনি বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ও ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে প্রতীকী হলেও আওয়ামী লীগকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া উচিত– ভারতের এই মনোভাব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অতি সম্প্রতিও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গেই এসেছে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অবতারণা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ‘জুলাই গণহত্যা’য় জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে, দলটি যে নির্বাচনে লড়তে পারবে না সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের নির্বাচন কমিশন– তাদের এখানে কোনও ভূমিকা নেই।
অন্য দিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের বরাবরই ঘোষিত অবস্থান হলো– এই নির্বাচন শুধু সুষ্ঠু ও অবাধই নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক হওয়াটাও জরুরি। ভারতের এই বক্তব্যকে পর্যবেক্ষকরা ব্যাখ্যা করছেন এভাবে– ভারত চায়, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনও না কোনও আকারে লড়ার সুযোগ পাক।
এই পটভূমিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চলতি সপ্তাহে এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একটি মন্তব্য করেছেন। ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা শুনেছি তা হলো, বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তাদের, যেভাবে এর আগে সে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে সমস্যা ছিল। তবে এটা আমাদের ইস্যু নয়, আমরা তাদের একজন হিতৈষী প্রতিবেশী– এটুকুই। কিন্তু এখন নির্বাচনটাই যদি বড় সমস্যা হয়, তাহলে এটাই তো আপনি ধরে নেবেন যে তাদের (অন্তর্বর্তী সরকারের) প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা।’
তিনি বলেন, আমরা আশা করি, সেই নির্বাচন শিগগিরই হবে, কারণ সেটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু দিনের শেষে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়েই যদি সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে সেটা করাটাই সবচেয়ে জরুরি।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু ও অবাধ হবে– ভারত এখনও সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না। তাছাড়া আওয়ামী লীগ যদি ভোটে লড়তে না পারে, তাহলে ভারতের চোখে অন্তত সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না– সেটাও তিনি প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কা ও নেপালের দৃষ্টান্ত আসছে কেন?
আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচনে লড়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কাছে এই দুটো দেশের উদাহরণ টেনে আনছেন। তারা বলছেন, ২০২২ সালের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল শ্রীলঙ্কা। দেশের তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ও তার মন্ত্রিসভার বহু সদস্যকেই। কিন্তু সেই ঘটনার দুবছর পর যখন শ্রীলঙ্কায় পার্লামেন্টারি নির্বাচন হলো, তখন রাজাপাকসের দলকে (শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরুমানা) ভোটে লড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অবশ্যই তারা গরিষ্ঠতার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরেছে, তারা অর্থনৈতিকভাবেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নেপালে জেন জির বিক্ষোভের জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সরকার। প্রধানমন্ত্রী ওলিসহ তার ক্যাবিনেট সদস্যরা অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে গা ঢাকা দেন। এরপর দেশের অন্তর্বর্তী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। সেখানেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দলকে (কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল– ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) নির্বাচনের বাইরে রাখার কোনও পরিকল্পনা নেই। তারাও অন্য সব দলের মতোই ভোটে লড়ার সুযোগ পাবেন। নেপালেও রাজনৈতিক সুস্থিরতা ফিরছে ধীরে ধীরে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটো দেশের সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে ভারত বলার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশেরও উচিত হবে শান্তি, প্রগতি ও সংহতির স্বার্থে দেশের সবগুলো প্রধান রাজনৈতিক শক্তিকেই নির্বাচনে লড়ার সুযোগ দেওয়া। না হলে শেখ হাসিনার আমলে যেসব নির্বাচন নিয়ে এত সন্দেহ ও অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকারও সে রকমই একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে।
তবে ভারতের এই পরামর্শ বাংলাদেশ আদৌ শুনবে কিনা, বা আওয়ামী লীগকে কোনও না কোনও আকারে আদৌ ভোটে লড়তে দেওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে বহু প্রশ্ন ও সংশয় আছে। যদিও দিল্লির বিশ্বাস, এই জটিলতা কাটানোর জন্য এখনও সমাধান বের করা সম্ভব।আস