দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতির অবসরের সময় ঘনিয়ে আসায় আইনাঙ্গনে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রধান বিচারপতি, সে বিষয়ে চলছে জোর আলোচনা।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছাড়া বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ছয়জন বিচারপতি রয়েছেন। জ্যেষ্ঠতা অনুসারে তারা হলেন– বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তাদের মধ্যে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়েও তারা প্রথম ও দ্বিতীয়।
সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রীতি অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে একমাত্র দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে ও নতুন নজির সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ জন বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। উত্তাল সেই সময়ে রাজপথে ছাত্র-জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে স্থান পাবে বলে মনে করেন আইন বিশ্লেষকরা। কারণ, অতীতে দায়িত্ব পালন করা দেশের অন্য সব প্রধান বিচারপতিকে আপিল বিভাগ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারও আপিল বিভাগ থেকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর মধ্যে একজন দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সংবিধান কী বলে
সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলে রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে ক্ষেত্র মতে অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত বা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করবেন।’
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ-সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দেবেন।
সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’ সংবিধানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলা হয়নি। তবে দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের যেকোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। জুলাই সনদেও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, আপিলের বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিই হবেন প্রধান বিচারপতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে। তিনি আপিল বিভাগের যেকোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার কথা বর্তমান সংবিধানে নেই। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনে কেউ কেউ বলেছিলেন, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম যিনি থাকবেন তিনিই হবেন প্রধান বিচারপতি। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন জ্যেষ্ঠতম দুইজনের মধ্যে একজন হবেন প্রধান বিচারপতি। সর্বশেষ জুলাই সনদে যেটা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেটা হলো আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। এখন সময় ঘনিয়ে এসেছে। আগামী ২৭ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রশ্ন আসবে তিনি কাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর বর্তমান সংবিধান ন্যস্ত করেছে। বর্তমান সংবিধানে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা নেই।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশন সরকারকে সুপারিশ করেছিল। তবে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির বিরুদ্ধে যদি গুরুতর কোনো অভিযোগ থাকে সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় জনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের কথা বলা হয় বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ১৫ জুলাই ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এ কে এম নুরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আর মা জাহানারা আরজু একুশে পদক প্রাপ্ত কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। মো. আশফাকুল ইসলাম ১৯৮৩ সালে জেলা আদালতের আইনজীবী হন।
১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হন। ২৭ আগস্ট ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন মো. আশফাকুল ইসলাম। ২৭ আগস্ট ২০০৫ সালে তাকে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি করা হয়। তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী
বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ১৯৬১ সালের ১৮ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রয়াত এএফএম আবদুর রহমান চৌধুরীও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্স ও এলএলএম ডিগ্রি নেওয়ার পর যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর আরেকটি মাস্টার্স করেন।
জুবায়ের রহমান চৌধুরী ১৯৮৫ সালে জজ কোর্টে ও ১৯৮৭ সালের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট জুবায়ের রহমান চৌধুরী অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পান। দুই বছর পর হাইকোর্ট বিভাগে তার নিয়োগ স্থায়ী হয়।
২০২৪ সালের ১২ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন এবং ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তিনি শপথ পাঠ করেন।
বিচারপতি মো. রেজাউল হক
বিচারপতি রেজাউল হকের জন্ম ১৯৬০ সালের ২৪ এপ্রিল। তিনি আইনে স্নাতক (এলএলবি) এবং কলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রেজাউল হক ৮ এপ্রিল ১৯৮৪ সালে জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২১ জুন ১৯৯০ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হন।
২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট রেজাউল হককে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। রেজাউল হককে ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট স্থায়ী বিচারক করা হয়। ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক
বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক ১৯৬৩ সালের ৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ইমদাদুল হক ১৯৯০ সালের ৭ অক্টোবর জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
তিনি ১৯৯২ সালের ২৬ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হন। ইমদাদুল হক ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২৩ আগস্ট ২০০৬ সালে তিনি স্থায়ী বিচারক হিসেবে দায়িত্বপালন শুরু করেন। ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ইমদাদুল হক।
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান
১৯৬৯ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এবং ২০০১ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান এ কে এম আসাদুজ্জামান। ২০০৫ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে স্থায়ী হন। ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে ও ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান।
সাবেক মন্ত্রী ও প্রখ্যাত অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মেয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। তিনি ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।