শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। গত বছর ছাত্র-জনতার প্রবল অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা, পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন; নিষিদ্ধ হয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম; বাতিল হয় নিবন্ধনও। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের এই অনুপস্থিতি শুধু শূন্যতাই তৈরি করেনি, বরং নতুন শক্তির উত্থান, পুরনো শক্তির পুনর্গঠন এবং সমাজ-রাষ্ট্রের মানসিকতাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক আলোচনায় রয়েছে অতি দক্ষিণপন্থি বা ডানপন্থি শক্তির উত্থান। সভা-সমাবেশ, গণসংস্কার, নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা, অনলাইন প্রচার-প্রচারণা- সব ক্ষেত্রেই এসব শক্তির দৃশ্যমান উপস্থিতি বেড়েছে। অনেকের মতে, এই উত্থান অপ্রত্যাশিত এবং দেশের রাজনৈতিক চরিত্র ও সামাজিক স্থিতির জন্য ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে। অন্যদিকে ডানপন্থি তথা ইসলামপন্থি দলগুলো বলছেÑ গত ১৫ বছর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের কারণে তারা মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেয়েছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সম্প্রতি বলেছেন, দক্ষিণপন্থার উত্থান দেশের রাজনৈতিক রূপরেখাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যেও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে, দেশি-বিদেশি পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি দক্ষিণপন্থার প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, বিভক্তি এবং কিছু দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা অতি ডানপন্থিদের কর্মকাণ্ডকে আরও দৃশ্যমান করে তুলছে। ডাকসু, জাকসু, চাকসু, রাকসু নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর তাদের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও বেড়েছে; বেড়েছে দলগুলোর সক্রিয়তা। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ধর্মভিত্তিক এসব দল এখনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে আসতে পারেনি।
গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তা এখন নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের এক ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে পড়ে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন মতাদর্শিক শক্তি। বিশেষ করে ডানপন্থি ও ইসলামপন্থি
দলগুলো এ সময়ে সবচেয়ে সংগঠিতভাবে মাঠে অবস্থান নিয়েছে। তাদের উপস্থিতি সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে সংস্কার ও নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনায় ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অনেকের মতে, এটি দেশের রাজনৈতিক চরিত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সংকেত।
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক চিত্রকে বড়ভাবে প্রভাবিত করেছে। একদা আওয়ামী লীগের সহযোগী জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে বিভিন্ন ফোরাম থেকে। সুতরাং, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিতে পারবে কি নাÑ সেই অনিশ্চয়তাও রয়ে গেছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও জাতীয় পার্টির অনিশ্চিত ভবিষ্যতে দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির দায়িত্ব এখন বিএনপির ওপর পড়েছে। উদার গণতান্ত্রিক অবস্থানের প্রতি দলের ঘোষণা এবং রাজনৈতিক স্থিতি ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা বিএনপির অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। যদিও দলটি রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের কঠিন কাজের মুখে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
সমান্তরালে জামায়াত ইসলামীসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর মাঠমুখী সক্রিয়তা বাড়ছে। জামায়াত এরই মধ্যে আটটি দলকে নিয়ে একটি জোট গঠন করেছে। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থিদের উত্থানের বিষয়টি আর আড়ালে নেই। সভা-সমাবেশে কিংবা সংস্কার ও নির্বাচনের মতো ইস্যুগুলোয় বেশ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে ইসলামপন্থিদের। গত ১৯ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। সেই সমাবেশে দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আগামী দিনের জাতীয় সংসদে শুধু ইসলাম চলবে। কোরআন এবং সুন্নাহর আইন চলবে। মানুষের তৈরি করা কোনো মতবাদকে জাতীয় সংসদে আর যেতে দেওয়া যাবে না। জুন মাসের ২৮ তারিখে একই জায়গায় মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায় তারা। দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক শক্তির এভাবে পুনর্গঠন অনেক নাগরিকের মনে শঙ্কা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগামী নির্বাচনের আগে ধর্মভিত্তিক শক্তির উত্থান রাজনীতির চরিত্রকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। যদিও এসব দল দাবি করছে, সংবিধানসম্মত পথেই তারা রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়া সংস্কার, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোকে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় আওয়ামী লীগ এখন সেভাবে আলোচনায় নেই। ক্ষমতার রাজনীতির আলোচনায় এগিয়ে আছে বিএনপি। এখন বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দুর্নীতির ইস্যুতে ব্র্যাকেটবন্দি করার পেছনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে পারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বামধারার রাজনীতি বর্তমানে বিভক্ত অবস্থায় আছে। কিছু দল বিএনপির সঙ্গে অবস্থান নিলেও অপর অংশ মতাদর্শিক শুদ্ধতা ধরে রাখতে পৃথক জোট গঠনের পথে এগিয়েছে। তবে তাদের ভোটব্যাঙ্ক ও গণভিত্তি সীমিত হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে না।
রাজনৈতিক আলোচনায় নতুন সংযোজন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণদের অংশগ্রহণে দলটি আলোচনায় আছে। তবে সারা দেশে এখনও সাংগঠনিক শক্তি সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। দলটি বিএনপি বা জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে জোটে যাওয়ার বিষয়ে আড়ালে আলোচনা চালালেও বর্তমানে এই দুই দলের বাইরে আলাদা জোট গঠনের দিকে আগাচ্ছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ খবর হলোÑ জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নতুন জোট হচ্ছে। এনসিপির নেতৃত্বে পাঁচটি রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম এবং আগ্রহী অন্যা দল মিলে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে এ জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বলে জানা গেছে। আসন্ন নির্বাচনের আগে এ জোট গঠন হলেও মূলত দীর্ঘমেয়াদে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিতে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে এ জোট ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনেও দলগুলো জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে। দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জোট গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে এক হয়েছে পাঁচটি রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় এ শক্তির অংশ হতে যাচ্ছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দল এনসিপি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন বাদে গণতন্ত্র মঞ্চের আরেকটি দলও জোটের অংশ হওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। পাশাপাশি গণঅধিকার পরিষদসহ বেশকিছু দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। তবে এককভাবে নির্বাচনে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা এনসিপির নেই বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। তাই অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তাদের শেষ পর্যন্ত কোনো জোটে যোগ দিতে হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল আমীন বেপারী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি দেশের রাজনীতিকে এক অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। কোন শক্তি ভবিষ্যতে প্রভাব বিস্তার করবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে নির্বাচন পরিচালনা, নতুন সরকারের গঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপর। ধর্মভিত্তিক শক্তির উত্থান, বিএনপির নেতৃত্বে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনর্গঠন, বামশক্তির সীমিত প্রভাব এবং নতুন দলগুলোর অনিশ্চয়তার মিশ্রণে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক রূপান্তরপর্ব অতিক্রম করছে। জামায়াত এখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার মতো সক্ষমতা এখনও অর্জন করেনি। তবে যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং জামায়াত বেশকিছু আসন পায়, তবে জাতীয় পর্যায়ে শক্তি অর্জন করবে। যদিও শেষ পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে সুবিধা করতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিনাত আরা নাজনীন বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিএনপি এখন বৃহৎ রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে ১৫ বছরের নিপীড়নের পর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেয়েছে। তাদের গঠনমূলক রাজনীতি এবং আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে। আমি মনে করি, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে মানুষ এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বলেই তারা শক্তিশালী হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় রাজনীতির ময়দানে দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান দৃশ্যমান বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থিদের শক্তি প্রকৃতপক্ষে যতটা নয়, সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও নিশ্চুপ মনোভাব তাদের শক্তির প্রদর্শনকে আরও বর্ধিত করছে। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরের নেতারা যেভাবে প্রকাশ্যে বলছেন, পুলিশ তাঁদের কথামতো কাজ করবে। এ ধরনের ফ্যাসিবাদী ভাষ্য এমনকি শেখ হাসিনার আমলেও কোনো মন্ত্রী বলেননি। সরকারের নীরবতার কারণেই তাঁরা এমন আচরণ করতে সাহস পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বাউল নিগ্রহ, মাজার ভাঙচুর ও প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে ‘পরিকল্পিত সন্ত্রাসী মনোভাব’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতের অর্থবল অনেক বেশি। কুমিল্লায় ১১ হাজার মোটরসাইকেলের মিছিল তারা নিজেদের কর্মীদের দিয়ে করতে পারে নাÑ এগুলো ভাড়া করা। ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণপন্থিদের এই প্রদর্শিত শক্তি আসলে ‘সরকারি নীরবতার সুযোগে তৈরি হওয়া এক ধরনের অহংকার’। বাস্তবে তাদের সামাজিক ভিত্তি এত শক্তিশালী নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।