পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণচুক্তির মেয়াদ আবারও বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ চলমান থাকায় এবং অর্থছাড় অব্যাহত রাখতে ঋণচুক্তির সময়সীমা তৃতীয়বারের মতো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার ও চীনের এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ঋণচুক্তি সই হয়। প্রথমে এই চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। পরে বাস্তবায়নে সময় বাড়ায় দুই দফায় ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। সেই সময় শেষ হওয়ায় আবার মেয়াদ বাড়ানো হলো। অবশ্য নির্মাণকাজ ও ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প দপ্তরে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি ইআরডি ও প্রকল্প দপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ঋণের মেয়াদ শেষ হলে অর্থছাড় বন্ধ হয়ে যায় এবং ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ আটকে যায়। এতে কাজের গতি কমে যায় এবং বাস্তবায়ন ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই কাজ নির্বিঘ্ন রাখতে ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প ছিল না।
এই প্রকল্পে মোট নির্মাণচুক্তির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ৩ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা।
প্রকল্প সূত্র জানায়, এক্সিম ব্যাংকের দেওয়া টাকার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের প্রায় ৯১ শতাংশ খরচ হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সম্প্রতি প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ হয়ে গেলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা ঋণের অবশিষ্ট টাকা খরচ করতে পারছিলেন না। ঠিকাদারদের বিল পরিশোধে জটিলতা তৈরি হওয়ায় কাজের গতি কমে আসে। ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় সময় লাগায় প্রশাসনিক জটিলতাও তৈরি হয়।
প্রকল্পের নভেম্বরের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯৭.৭০ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ।
২০২৩ সালে প্রকল্পের একাংশ চালু করা হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা থেকে সরাসরি যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তবে এখনো কিছু নির্মাণকাজ বাকি রয়েছে। বিশেষ করে কমলাপুরে কর্মচারী ভবন নির্মাণ, ভাঙ্গা জংশনে গ্লাস ও এসি বসানোসহ কয়েকটি ফিনিশিং কাজ শেষ হয়নি। রেললাইনের সংকেত ব্যবস্থার পরীক্ষার কাজও চলমান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নাজনীন আরা কেয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এই প্রকল্পে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত মোট ২৩৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে জি-টু-জি পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হলো চায়না রেলওয়ে গ্রুপ।
প্রকল্পের নথিতে দেখা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬২৮ দশমিক ৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নির্মাণ চুক্তিতে ব্যয় ২৪ হাজার ৭৪১ কোটি, ভ্যাট ও ট্যাক্স ৮ হাজার কোটি, ভূমি অধিগ্রহণে ৪ হাজার কোটি, পুনর্বাসনে ২০০ কোটি, ইউটিলিটি স্থানান্তরে ৩০০ কোটি, পরামর্শক ব্যয় ১ হাজার ৩৩৩ কোটি এবং বেতন-ভাতা ও অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয় ৫০ কোটি টাকা।
ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঋণের মেয়াদ বারবার বাড়ানো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক বার্তা দেয় না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়াই মূলত ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর কারণ, যা দাতাদের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। করোনার সময়ে কাজের গতি কমলেও পরে অতিরিক্ত জনবল ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ করা যেত। প্রকল্প দীর্ঘায়িত হলে ব্যয় বাড়ে, কাজ ঝুলে যায় এবং সার্বিকভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’