চুরি, ছিনতাই, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের অভিযোগে গণপিটুনিতে মৃত্যু বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে মব তৈরি করে ১৬৫ জনকে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ঢাকায় নিহত হয়েছেন ৭২ জন। গত রবিবার এক রাতেই ফরিদপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও পিরোজপুরে চারজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনের প্রতি আস্থাহীনতা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এ ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতাবান বা কৌশলী ব্যক্তিরা সহজেই মানুষ জড়ো করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছেন। মানিকগঞ্জে বাউলদের মারধরের মতো ঘটনা জানিয়ে দিচ্ছে, মামলা হলেও গ্রেপ্তার বা শাস্তির নজির খুব কম। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পৌনে ৮ বছরে ৫৪৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে পাওয়ার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় এসব ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধী হলেও ব্যক্তিকে মারধর কিংবা পিটিয়ে হত্যার সুযোগ নেই। যাঁরা আইন হাতে তুলে নেবেন, তারাও অপরাধী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জড়িতদের ধরতে পুলিশের তৎপরতা কম। সরকার মৌখিকভাবে কঠোর অবস্থান নিলেও মাঠপর্যায়ে তা ঠেকানো যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়েও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত পৌনে ৮ বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৫৪৭ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে নিহত হন ৩৯ জন, তাঁদের মধ্যে ঢাকায় নিহত হন ২১ জন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৬৫ জনকে (ঢাকায় ২২ জন) গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে নিহতের সংখ্যা কমে হয় ৩৫ জন, ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৮ জন, ২০২২ সালে বেড়ে হয় ৩৬ জন। ২০২৩ সালে নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে হয় ৫১ জন, এর মধ্যে ঢাকাতেই ২৫ জন। ২০২৪ সালে তা আডাই গুণ বেড়ে হয় ১২৮ জন। আর চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) নিহত হন ১৬৫ জন। চলতি বছরের পরিসংখানে দেখা গেছে, ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এরপর চট্টগ্রামে ২৮, খুলনায় ১৭, বরিশালে ১৪, রাজশাহীতে ১৩, ময়মনসিংহ ১০, রংপুর ৭ এবং সিলেটে চারজন নিহত হন।
এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আইনের শাসনের অভাবে কোনো ঘটনায় মানুষ নিজেরাই ‘বিচার’ করছে। গণপিটুনিগুলো অধিকাংশই পরিকল্পিত। শুধু অপরাধীরা মারা যাচ্ছেন, বিষয়টা এমন নয়। নিরাপরাধ মানুষকেও পরিকল্পিত হত্যা করা হচ্ছে। ক্ষমতাবান কিংবা কৌশলী ব্যক্তি কিছু মানুষ জড়ো করতে পারলেই কাউকে গণপিটুনি দিয়ে মারতে পারছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে গভীর তদন্ত দরকার, সেটাও দেখা যাচ্ছে না। কারও ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাতে কোনো ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি শাসন করার সুযোগ নেই। এটা একেবারেই আইনের শাসনের পরিপন্থি।
তৌহিদুল হক বলেন, আসামি গ্রেপ্তার ও মামলায় সাজারও বেশি নজির নেই। মানিকগঞ্জে বাউলদের মারধরের জন্য কাউকে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে। একবার যদি এই উদাহরণ সৃষ্টি হয়, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেললে কিছু হবে নাÑ সেখানে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে আইনের শাসন কার্যকর করা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পটপরিবর্তনের পর গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে মারধরের শিকার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিচারপতিও। সেই ধারাবাহিকতায় গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। রাজনৈতিক প্রতিক্ষপ থেকে ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষকে হত্যার ঘটনা ঘটছে।
গণপিটুনিতে হত্যার তালিকায় প্রতিবন্ধী ও শিশুরাও রয়েছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিষ্ক্রিয়।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, সমাজে এক ধরনের অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে কিংবা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি পুনর্গঠন হয়নি। এ রকম একটা সময়ে দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। তবে সরকারের উচিত শক্ত হাতে দমন ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের এমনভাবে স্বাধীন ভাবা হচ্ছে যে, কোনো নিয়মনীতি বা আইন মানার চেষ্টা করা হচ্ছে না। অতীতের বিচারহীনতার কারণে অনেকেই পুলিশ প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। ফেসবুক কেন্দ্রিক অপপ্রচারের মাধ্যমেও গণপিটুনির পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, নিজেরাই বিচার করবে। এটা অশনি সংকেত। রাষ্ট্রের কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দলীয় কর্মীদের কঠোর বার্তা দিতে হবে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গণপিটুনির ঘটনায় মামলা হলেও বিচার হওয়ার নজির কম। সুষ্ঠু বিচার হলে তাতে একটা বার্তা থাকে। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এখনও মামলাটি আপিল আদালতে ঝুলে আছে। এভাবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও অপরাধের ঘটনা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপিটুনির বড় অংশের পেছনে মতলববাজ বা সুযোগ সন্ধানীরা থাকেন। দুই-চারজন মিলে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করলে নির্ণয় করা সহজÑ কার পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শত শত লোক যখন গণপিটুনিতে অংশ নেয়, তখন তা নির্ণয় করা কঠিন। ফলে যে কোনো নির্বাচনের আগে বা কোনো বিশেষ সময়ে গুজব রটিয়ে বা অন্য কোনো কারণে গণপিটুনি বেড়ে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, গণপিটুনির ঘটনাগুলোয় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে। অনেক সময় প্রমাণ সংগ্রহ জটিল হয় বলে অপরাধীদের শনাক্ত করতে সময় লাগে। তবে কোনো ঘটনাই তদন্তের বাইরে নয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব-সহিংসতার কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
কুমিল্লায় ধরে এনে যুবককে হত্যা : চান্দিনার বরকরই ইউনিয়নের চাঁদসার গ্রামে ছিনতাইকারী সন্দেহে মো. মুছা (২৬) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত রবিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকজন তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে মারধর করেন। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা জানান, চাঁদসার গ্রামের ময়নাল হোসেন কাদুটি বাজারে মোবাইল ফোনের ব্যবসা করেন। প্রায় ১০ দিন আগে বাড়ি ফেরার সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। তাঁর দাবি, নগদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা ও কয়েকটি মোবাইল ফোন সেট কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। ওই ঘটনায় মুছাকে সন্দেহ করা হয়। মুছাও ৮ থেকে ১০ দিন বাড়িতে না থাকায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। রবিবার রাতে মুছা বাড়িতে এলে ময়নাল, তোফাজ্জলসহ কয়েকজন এসে মুছাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গণপিটুনি দেন। এতে তাঁর মৃত্যু হয়।
চান্দিনা থানার ওসি জাবেদ উল ইসলাম বলেন, ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে প্রাথমিকভাবে তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
ফরিদপুরে নিহত ১, আহত ৩ : নগরকান্দার দেবীনগর গ্রামে রবিবার গভীর রাতে ‘সন্দেহজনক চলাফেরার’ অভিযোগে স্থানীয়রা পাঁচজনকে ধরে মারধর করেন। এ ঘটনায় শাহীন শিকদার (২৮) নামে একজন মারা যান। আহত হন সুমন, পারভেজ ও ইনামুল। তাঁরা নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দেবীনগর গ্রামের রাস্তায় গভীর রাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখে কয়েকজন সন্দেহ প্রকাশ করেন। পরে পাঁচজনকে আটক করে পিটুনি দেওয়া হয়। এ সময় একজন পালিয়ে যান। গুরুতর আহত শাহীনকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অন্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নারায়ণগঞ্জে নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা : বন্দরের সোনাচড়া এলাকায় চোর সন্দেহে পারভেজ নামে এক নির্মাণ শ্রমিককে মারধর করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পারভেজের স্ত্রী খাদিজা বেগমের অভিযোগ, বৈদ্যুতিক তার চুরির মিথ্যা অভিযোগে তাঁর স্বামীকে রাতে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত পারভেজ বন্দর এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন।
বন্দর থানার ওসি জানিয়েছেন, রবিবার রাতে মেসবাহউদ্দিন ও তাঁর দুই ছেলে চুরির অভিযোগ তুলে পারভেজকে আটক করে মারধর করে। সকালে তাঁর মৃত্যু হলে তারা পালিয়ে যান।
পিরোজপুরে গণপিটুনিতে নিহত এক : পিরোজপুরে গণপিটুনিতে সবুজ হাওলাদার (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গত রবিবার ভোররাতে সদর উপজেলার পশ্চিম দুর্গাপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য অনুকুল চন্দ্র রায় ওরফে দুলালের বাড়ি থেকে ডাকাতির সময় তাঁকে আটক করে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ফরিদপুর, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি)