সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক (ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজিন অংশ) নির্মাণ প্রকল্পে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ঠিকাদারকে বাড়তি বিল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় লিখিত অভিযোগও তুলে ধরা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার স্বাক্ষরিত এক কার্যপত্র থেকে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় হস্তান্তর সার্টিফিকেট স্বাক্ষর জালিয়াতি এবং বিভিন্ন প্যাকেজে বাড়তি বিল দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। উল্টো তাঁকে পছন্দের জায়গায় বদলি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু তাই নয়, মোহাম্মদ নাসরুল্লাহর বিরুদ্ধে বিগত আমলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ঘুষ ও কমিশন বণিজ্য, বিদেশে অর্থ পাচার ও কানাডায় বাড়ি ক্রয়, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ অভিযোগ, ১০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে তিনি তাঁর পছন্দের জায়গায় বদলি হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, যেখানে বড় প্রকল্প, সেটাই পছন্দের জায়গা হয়ে উঠে মোহাম্মদ নাসরুল্লাহর।
খোঁজ জানা গেছে, প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ গত সরকারের মেয়াদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সবচেয়ে ঘনিষ্ট ও আস্থাভাজনক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় সবসময় কাজ বেশি থাকে, তাই চতুর নাসরুল্লাহর পছন্দের জায়গা হয়ে পড়ে কুমিল্লা। এ জন্য তিনি কর্মজীবনে চাঁদপুরে আট মাস এবং লক্ষ্মীপুরে এক বছর তিন মাস দায়িত্ব পালন শেষে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবরে কুমিল্লা জেলায় বদলি হোন। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ‘উন্নয়ন সমন্বয়ক’ ও ডিপিএইচইয়ের ঠিকাদার মো. কামাল হোসেনকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কুমিল্লায় বদলি হন। কুমিল্লা গিয়ে কামাল হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে নসরুল্লাহর।
কুমিল্লায় থাকাকালীন কামাল ও সাবেক মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতিসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন এই দুজন। ওই সময় বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন এই কর্মকর্তা। গেল বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে দুবাই পালিয়ে যান কামাল হোসেন। এরপর থেকেই কুমিল্লা থেকে সরে আসার পথ খুঁজছিলেন মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ। বিগত সময়ে কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ কুমিল্লা থেকে কক্সবাজারে গেছেন। কারণ, এই সময়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্পের কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। সারা দেশে ডিপিএইচইর যত কাজ চলমান রয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকের বেশি কাজ চলছে শুধু কক্সবাজার জেলায়। যে কারণে এই জেলাকেই বেছে নিয়েছেন নাসরুল্লাহ। কারণ, যেখানে কাজ বেশি সেখানেই চোখ পড়ে এই কর্মকর্তার। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তাঁর অনৈতিক অর্থ লেনদেন হয়েছে শাশুড়ি, দুই শ্যালক এবং বড় ভাইয়ের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।
অনিয়মের এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে নাসরুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি। তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগÑ তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ নভেম্বর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কুমিল্লা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহকে কুমিল্লা থেকে কক্সবাজারে বদলির আদেশ জারি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ১০ কোটি টাকার বিনিময় পছন্দের জায়গায় বদলি বাগিয়ে নিয়েছে তিনি। বদলির পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিপিএইচইর কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে এই সময় এমন ‘প্রমোশনাল বদলি’ মেনে নেওয়ার মতো নয়। নাসরুল্লাহ বিগত সরকারের মন্ত্রীর একজন চিহ্নিত সহযোগী। আর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন একজন জুলাই যোদ্ধা। তাঁর আমলে এমন বদলি আমাদের হতাশ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর আগে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নাসরুল্লাহকে কুমিল্লা থেকে ফেনী জেলায় বদলি করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল ডিপিএইচই। তখন এ বদলি ঠেকিয়ে দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে যানা যায়, নাসরুল্লাহ নবম গ্রেডের কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সাবেক মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে পঞ্চম গ্রেডে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে জনস্বাস্থ্যে চাকরি করেন। বর্তমানে মো. নাসরুল্লাহর মূল বেতন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, সরকারি চাকরির সময় থেকে এ পর্যন্ত তাঁর মোট বৈধ আয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। কিন্তু কুমিল্লা জেলায় বদলির পর গত ৫ বছরে টেন্ডারের মাধ্যমে শতকোটি টাকার বেশি কমিশন বাণিজ্য করেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে নাসরুল্লাহর ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যের বেশ কয়েকটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর মেসার্স সম্পা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে পে-অর্ডারের মাধমে মিলন মিয়া ও এমডি দবির উদ্দিনের অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন নাসরুল্লাহ। ২০২২ সালের বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজের ও শ্বশুরালয়ের লোকজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার ওপরে ঘুষ লেনদেন করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট, স্ত্রী, শাশুড়ি, দুই শ্যালক ও বড় ভাইয়ের ব্যাংক স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে তাঁর অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাঁর বিশ্বস্ত ঠিকাদারদের অ্যাকাউন্ট চেক করেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ঘুষের টাকা দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় পাঁচ তলা বিলাস বহুল ভবন ও পূর্বাচলে ১০ কোটি টাকার প্লট কিনেছেন। এ ছাড়া কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে তাঁর বড় ভাই মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর নামে ৫০ একর জমি এবং ৮০ লাখ টাকায় দুটি প্রিমিও গাড়িও কিনেছেন তিনি। একটি গাড়ি নিজে ব্যবহার করেন (ঢাকা মেট্রো-গ-২০-৮৫১৩) অন্যটি ব্যবহার করেন তাঁর স্ত্রী বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা সুরাইয়া সানজিদা চৌধুরী। দুর্নীতির টাকার বেশিরভাগই কানাডাতে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কানাডায় নিজ নামে বাড়ি ও সম্পদ করারও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
অনৈতিক লেনদেনের কয়েকটি ব্যাংক স্টেটমেন্টের চিত্র : নাসরুল্লাহ ও তাঁর পরিবারের ব্যাংক স্টেটমেন্টের কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ২৬ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের প্রিমিয়ার ব্যাংকের কুমিল্লা ব্রাঞ্চ (অ্যাকাউন্ট-০১৩৭১১১০০০০....) থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাসরুল্লাহর নিজ অ্যাকাউন্টে (০২১১১১০০০....) ইউনিয়ন ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চ ২ লাখ টাকা আরটিজিএসের মাধ্যমে ট্রান্সফর করা হয়। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শম্পা এন্টারপ্রাইজের এনআরবিসি ব্যাংক কুমিল্লা ময়নামতি ব্রাঞ্চ (অ্যাকাউন্ট-০১৩৪৩৩....) থেকে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আরটিজিএসের মাধ্যমে পাঠানো হয় তার শাশুড়ি মোসা. রেহানা আক্তার চৌধুরীর (০২১১১০০০....) ইউনিয়ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে ।
২০২২ সালের ২৪ মার্চ নাসরুল্লাহর স্ত্রী মোসা. সুরাইয়া সানজিদা চৌধুরীর (অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১৮০৩১০০৩....) মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবলি ব্রাঞ্জে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামীম ট্রেডার্সের দিদার ই আলমের ফরিদগঞ্জের এনআরবিসি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (৫০১৭৩১১০০০০....) থেকে ২ লাখ ৫০ লাখ টাকা পাঠানো হয়। ২০২২ সালের ১৯ মে মেসার্স শামীম ট্রেডার্সের দিদার ই আলমের এনআরবিসি ব্যাংক ফরিদগঞ্জের সাব ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট (৫০১৭৩১১০০০০....) থেকে তাঁর শ্যালক মো. শাহিনুর জামান চৌধুরীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিউ আদর কসমেটিকসের (অ্যাকাউন্ট- ১৫৮৩৩০০....) নামে অর্থ পাঠানোর প্রমাণ রয়েছে।