Image description

সুমাইয়া আফরিন রান্না করছিলেন। ভার্টিগো নামক অসুস্থতা থাকায় ভেবেছিলেন, তাঁর মাথা ঘোরাচ্ছে। কিন্তু চুলায় থাকা ভাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন, কিছু একটা ঘটছে।

গোসলে থাকা মেয়ের চিৎকার কানে আসে সুমাইয়ার। তিনি কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে গ্যাসের চুলা বন্ধ করেন।

চারপাশের জিনিসপত্র, থাই গ্লাসের জানালায় ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। এরপর বাথরুমের সামনে গিয়ে দেখলেন, তাঁর মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মেয়েকে টাওয়েল দিয়ে জড়িয়ে তিনতলা থেকে নেমে গ্যারেজে আসেন।

তখনো চারপাশ দুলছে। কাঁপুনি থামার পর আবার মেয়েকে কোলে করে তিনতলায় নিয়ে ফ্রক পরিয়ে নিচে এসে অন্যদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন সুমাইয়া।

রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বরের বাসিন্দা সুমাইয়া এভাবেই গত শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ৮ বছর বয়সী মেয়ে তাসনুভা আফরিনকে নিয়ে সে সময় বাসায় একাই ছিলেন এই মা। মেয়ের বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে ছিলেন।

শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। এই ভূমিকম্পে শিশুসহ ১০ জন নিহত হন। আহত ছয় শতাধিক ব্যক্তি। পরদিন শনিবার তিনবার ভূমিকম্প হয়।

সুমাইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন মেয়ে চোখ খোলার পর থেকে সমানে চিৎকার করছিল। বলছিল, মা, বাড়ি ক্র্যাশ করছে। আমাকে সেফ জায়গায় নিয়ে যাও। আমি ঢাকায় থাকতে চাই না।’

 

ঘটনার পর থেকে মেয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকছে বলে জানালেন সুমাইয়া। তিনি বলেন, মেয়ে এখন বাথরুমে যেতে ভয় পাচ্ছে। রাতে ঘুমাচ্ছে না। চারপাশে কোনো শব্দ শুনলেই ভয় পাচ্ছে। ভুল বকছে, অসংলগ্ন কথা বলছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গতকাল রোববার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সুমাইয়া। তবে আবার ভূমিকম্প হতে পারে ভেবে মেয়ের স্কুলের সামনে পুরোটা সময় বসে ছিলেন তিনি।

সুমাইয়া বলেন, ‘আমার এই বয়সে এমন ভয়ের পরিস্থিতি আর দেখিনি। আমি নিজেও তখন কী করেছি, জানি না। মেয়েকে স্বাভাবিক করার জন্য ভাবছি, ওকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাব।’

এমন পরিস্থিতিতে শিশু তো বটেই, বড়দেরও ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মত দেন মনোচিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। পাশাপাশি ভূমিকম্প হলে করণীয়গুলো শিশুদের আগেই জানিয়ে রাখতে হবে।

রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসিন্দা শামীমা আক্তার। তিনি জানালেন, তাঁদের চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে আফরা নাওয়ারকে নিয়েও তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। তাঁদের বাসা ১০ তলায়। শুক্রবারের ভূমিকম্পে মেয়ে খুবই ভয় পায়। তখন কোনোভাবে তাকে শান্ত করা হয়। কিন্তু শনিবার আবার ভূমিকম্প হলে আর কোনোভাবেই মেয়েকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকার খবরাখবরসহ বড়দের আলোচনা থেকে তার ধারণা হয়েছে, আরও বড় ভূমিকম্প হবে। এটা সে মানতে পারছে না।

শামীমা বলেন, মেয়ে শুধু বলছে, এত কম বয়সে মরে যেতে হবে? সে হয় বিদেশে, নয়তো গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। সে কোনোভাবেই ঢাকায় থাকবে না। রোববার মেয়েকে স্কুলে পাঠানো যায়নি। সে বলছে, পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। রাতে ঘরের লাইট পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে।

তাসনুভা-আফরাদের মতো আরও অনেক শিশুই ভূমিকম্পের পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল। অভিভাবকেরা বলছেন, সন্তানের এমন পরিস্থিতি দেখে তাঁরা উদ্বিগ্ন। কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।

ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক মা অনিমা ফেরদৌস ফেসবুকে শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময়কার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তিনি তখন কর্মস্থলে এক শিশু রোগীকে দেখছিলেন। তাঁর সন্তানেরা ছিল ঢাকার বাসায় গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে।

বাসার দরজায় তালা লাগান না এই মা। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় দরজা কোনোভাবে আটকে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের দুলুনি থামলে তিনি সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেন, তাঁর বড় মেয়েসন্তান আর গৃহকর্মী দরজা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু দরজা খুলতে পারছে না। আর ছোট ছেলেসন্তান চিৎকার করে কাঁদছে। প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙে বাচ্চাদের বের করেন। অন্য স্বজনেরাও পরে বাসায় আসেন।

কর্মস্থল থেকে রাত ১০টায় এই মা বাসায় ফেরেন। ৫ বছর বয়সী ছেলে ঘুমানোর আগে মাকে বলে, ‘আমাকে কেন বাসায় রেখে গিয়েছিলা? আমি তো ভয় পাই ভূমিকম্প, জানো না?’

অনিমা ফেরদৌস তাঁর ফেসবুক পোস্ট শেষ করেছেন, ‘কী অনিশ্চিত জীবন আমাদের’ লিখে।

শুক্র-শনিবার প্রায় ৩১ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশে চারটি ভূমিকম্পের ঘটনায় ঝুঁকির দিকটি যেমন সামনে এসেছে, তেমনি মানুষের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে।

কয়েকজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের ট্রমা বা ভীতি কীভাবে দূর করবেন, কীভাবে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক রাখবেন, আবার বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী করবেন, এসব নিয়ে তাঁরা ভাবছেন।

এ বিষয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ভয় পাবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেউ ভয় পেলে সে মানসিকভাবে দুর্বল, তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ভূমিকম্পের মতো ঘটনায় করণীয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। ভয় পাওয়া ব্যক্তি বা শিশুদের দ্রুত স্বাভাবিক কাজে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। বন্ধু-স্বজন থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। অনেক সময় পরিবারের বড় সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তা শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। বুঝতে হবে, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে।

ভয় পেয়েছে—এমন শিশুদের বেলায় তারা যাতে রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, শিশুরা আবার আতঙ্কিত হয়ে যেতে পারে, এমন আলোচনা তাদের সামনে করা যাবে না। আর আতঙ্কিত হওয়ার মাত্রা যদি বেড়ে যায়, তাহলে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

ফেসবুকে গুজব-মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি থাকে বলে উল্লেখ করেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। এর বাইরে ভূমিকম্পের সময় করণীয়গুলো যাতে বাস্তবসম্মত হয়, সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।