দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন গত ১৩ বছরে প্রায় তিন হাজার ৩৬০ বাংলাদেশি স্থায়ী কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা নেমে এসেছে এক হাজার ৬৪০ জনে। দেশীয় কর্মীদের ছাঁটাই করার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়Ñতারা প্রযুক্তিতে অদক্ষ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী, কুচক্রী, অসুস্থ, আহত, শারীরিকভাবে অক্ষম, শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য ও কোম্পানির স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত।
ছাঁটাই হওয়া বাংলাদেশি কর্মীরা যেসব কাজ করতেন, তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা ভারতীয় মালিকানাধীন দুই প্রতিষ্ঠান জেনেক্স এবং উইথপ্রোকে। এছাড়া শীর্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় ভারতীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে মুদ্রা পাচার, কমিশন বাণিজ্য, সেবার মানের অবনতি ও তথ্য পাচারের মতো ঘটনা ঘটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রামীণফোনে চাকরিরত একটি চক্র ব্যক্তিগত লাভ এবং ভারতীয় দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এসব কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের শ্রমক্ষেত্রকে অস্থিতিশীল করা। এজন্য তারা কোম্পানিটিতে বাংলাদেশি যোগ্য শ্রমিকদের জায়গায় চুক্তিভিত্তিক ভারতীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্পর্শকাতর কাজ করাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগবিরোধী, কোম্পানির বেআইনি কার্যক্রমের বিরোধিতাকারী এবং ম্যানেজমেন্টে থাকা দুর্নীতিবাজদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দের কারণে এতদিন চাকরিচ্যুত হয়েছেন বাংলাদেশি কর্মীরা।
শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের অন্যতম এ মোবাইল অপারেটরের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিকরা। তারা হলেনÑচিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) জয় প্রকাশ, চিফ ইনফরমেশন অফিসার (সিআইও) নিরঞ্জন শ্রীনিবাসান, চিফ প্রকিউরমেন্ট অফিসার (সিপিও) ভাঙ্গু কাওস্টুভ, হেড অব সোর্সিং কুসতাভ এবং প্রকৌশল বিভাগের প্রধান শ্রীভাব। কোম্পানির সব তথ্য তাদের হাতের নাগালে রয়েছে।
ছাঁটাই হওয়া একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্য দেশের যোগ্য ব্যক্তিরা গ্রামীণফোনের বিভিন্ন পদে আবেদন করলেও তাদের নেওয়া হয় না। নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য হিসেবে শুধু ভারতীয়দেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন ভারতীয়দের প্রাধান্য দেওয়া হয়Ñবিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়ে রোষানলের শিকার হতে হয়েছে অনেককে। এর মধ্যে অনেককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
তারা আরো জানান, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে যে তিন হাজার ৩৬০ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদের পাওনা এখনো বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। পাওনার দাবিতে আন্দোলন চলছে। সে আন্দোলন দমাতে পুলিশ দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে।
বকেয়া আদায়ের আন্দোলন করা গ্রামীণফোনের একাধিক সাবেক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৩ বছরে গ্রামীণফোনে যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছাঁটাইয়ের শিকার হতাশাগ্রস্ত রাজিব নামে একজন গত এপ্রিলে মারা গেছেন।
তবে গ্রামীণফোনের দাবি, নিয়ম মেনেই তাদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের পাওনা টাকাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামীণফোন ক্রমাগতভাবে দেশীয় কর্মীদের ছাঁটাই করেছে। অনেকেই চাকরি ছাড়তে রাজি না হওয়ায় তাদের মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। যেমনÑইচ্ছাকৃতভাবে বেশি কাজ করানো, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাসার বাজার করানো, ফোন করে ভয়ভীতি প্রদর্শন, ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া, পাহাড় ও হাওর এবং দুর্গম এলাকায় বদলি করা, অতিরিক্ত কাজের টার্গেট দেওয়া, জরুরি কাজের কথা বলে অফিসে বসিয়ে রাখা এবং ট্রেনিংয়ের কথা বলে বিদেশে মাসের পর মাস থাকতে বাধ্য করা।
আন্দোলনকারীরা জানান, ২০১০ সালে সরকারের জারি করা এসআরও অনুযায়ী টেলিকম খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ৫ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার কথা থাকলেও গ্রামীণফোন তা দেয়নি। পরে শ্রমিকরা আইনি লড়াইয়ে গেলে একাধিকবার আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি সামান্য কিছু অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু শ্রমিকদের পুরো প্রাপ্য কোম্পানিটি বুঝিয়ে দেয়নি।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩১ মে ১৮০ স্থায়ী কর্মীকে ‘লক আউট’ করে গ্রামীণফোন। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর কর্মীদের কাজে পুনর্বহালের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুট উত্থাপন করে গ্রামীণফোন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (জিপিইউ)। কিন্তু তখন প্রতিষ্ঠানে একাধিক ইউনিয়ন রয়েছে যুক্তি দেখিয়ে জিপিইউয়ের আপত্তি খারিজ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি একই আপত্তি শ্রম অধিদপ্তরের সালিশি শাখায় উত্থাপন করে ইউনিয়ন বলে, গ্রামীণফোন শ্রম আইন ভঙ্গ করে ১৮০ কর্মীকে কাজ থেকে বিরত রেখেছে। একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রম অধিদপ্তর ডিসপুট খারিজ করে দেয়। এরপর বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্টে। অধিদপ্তরের খারিজের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে ভুক্তভোগী কর্মীদের ইউনিয়ন। ওই বছরের ২০ জুন গভীর রাতে ১৫৯ জন স্থায়ী কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এ ছাড়া গ্রামীণফোনে ভারতীয় কর্মীদের আলাদা কদর রয়েছে বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরু থেকেই গ্রামীণফোনে ভারতীয় নাগরিকদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমনÑ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিবেক সুদ। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রিজভী শেঠি। ২০১৮ সালে হেড অব প্রোডাক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৌরভ প্রকাশ। প্রধান নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দিলীপ কুমার। সিটিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যোগেশ। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হেড অব সার্ভিসে ছিলেন হিতেষ সুদ। হেড অব কালেকশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শরবোজিৎ সিং। জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন রবিন্দ্র শিখর।
গ্রামীণফোনের একাধিক কর্মী জানান, প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর ও বিভাগীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহু ভারতীয় নাগরিক কর্মরত।
২০২১ সালে চাকরিচ্যুত ও বকেয়া আদায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাদাত মো. শোয়েব। গ্রামীণফোনের স্পেশালিট হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। আমাদের ওপর পুলিশি হামলা চালানো হয়েছে। অবিলম্বে আমাদের পাওনা পরিশোধ করা হোক। নইলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটারনাল কমিউনিকেশন আংকিত সুরেকা গত বুধবার আমার দেশকে জানান, গ্রামীণফোন দেশের সব আইনকানুন ও বিধিবিধান মেনে ব্যবসা পরিচালনা করে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিক নয়।
গ্রামীণফোনের কিছু সাবেক কর্মী চাকরিসংক্রান্ত নানাবিধ দাবিদাওয়া নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে একটি প্রচার চালাচ্ছেন। আমাদের জানামতে তাদের বেশিরভাগ কয়েক বছর আগেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যান এবং আইন অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য গ্রহণ করেন।
তিনি আরো জানান, তারা যে দাবিগুলো তুলেছেন সেগুলো বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। বিচারিক ব্যবস্থার প্রতি গ্রামীণফোন শ্রদ্ধাশীল। তাই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতেই এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে বলে বিশ্বাস করে গ্রামীণফোন।
নিয়োগে ভারতীয়দের প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণফোন বৈশ্বিক মানদণ্ড ও সুশাসনের নিয়ম মেনে কয়েক ধাপের বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে।