Image description

ভূমিকম্পে গত শুক্রবার একটু নাড়া দিয়েছে। যেকোনো সময় আবার নাড়া দিতে পারে। কারণ ঢাকার পাশে মাধবদী, মধুপুর ফল্ট এবং নোয়াখালী থেকে ঢাকা হয়ে সিলেট পর্যন্ত আরেকটি ফল্ট (চ্যুতি) রয়েছে। এগুলো এতদিন সুপ্ত ছিল। রাজধানীর আশপাশে আগেই ফল্ট ছিল। প্রায় একযুগ আগে সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) এ নিয়ে কাজ করার সময় এ তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল শনিবার ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে এসব মতামত জানান।

তিনি বলেন, ডাউকি ফল্টের কারণে প্রকৃতিগতভাবে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন হিসেবে সিলেট চিহ্নিত হলে ঢাকার অবস্থা হবে ভয়াবহ। ভূমিকম্পে মানুষ মরে না। মারা যাবে বিল্ডিং ধসে পড়ার কারণে। এ সময় মানুষ উদ্ধার করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সংকুচিত হওয়ার কারণে ঢাকায় বেশি মানুষ মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, দুটি কারণে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানি বেশি হবে। এর মধ্যে একটি হলো-অপরিকল্পিত বাড়ি-ঘরে জনবসতি বেশি এবং ‘ভরাট মাটির’ ওপর হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ। তিনি বলেন, ঢাকা-৩ নম্বর জোনে আর সিলেট-৪ নম্বর জোনে অবস্থিত।

গত শুক্রবার ঢাকার মানুষকে একটু নাড়া দিয়ে গেছে। যেকোনো সময় আবার নাড়া দিতে পারে উল্লেখ করে ড. মুস্তাক বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) চেঞ্জ করে ফেলেছে। এতে আরো ঘনবসতি বাড়বে, হাইরাইজ বিল্ডিং হবে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সিলেট সবসময় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ঝুঁকি আরো বেড়েছে। ১৮৯৭ সালে আসামে বড় ধরনের ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৬।

গত চার-পাঁচ বছর থেকে কয়েক দফা ছোট ও মধ্যম ভূমিকম্প হওয়ায় সিলেটজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। ২০২১ সালে ঘনঘন ভূমিকম্পন অনুভূত হয়। দিনে ৫-৭ বারও ভূমিকম্প হয়েছে। এ নিয়ে সিলেটে নেই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানো ও উদ্ধারকাজ চালানোর মতো কোনো প্রস্তুতি ও সচেতনতা। যখনই ভূমিকম্প হয় তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে সিলেট সিটি করপোরেশন। কিন্তু তারপর তা আবার আলোচনার আড়ালে চলে যায়।

শাবিপ্রবির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, যে টেকনোটিক প্লেটে সিলেট অঞ্চল অবস্থিত, তা ক্রমেই উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। প্রতি একশ বছরে তা এক মিটার সরছে। এ কারণে সিলেট অঞ্চলের ভূমিকম্পের ঝুঁকি দিনদিন আরও বাড়ছে।

শাবিপ্রবির অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ জানান, সিলেট প্রকৃতিগতভাবে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে। ডাউকি ফল্ট সিলেটের খুবই সন্নিকটে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে যত্রতত্র অসংখ্য বিল্ডিং গড়ে উঠেছে, যা এই নগরীর জন্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ।

অধ্যাপক ড. মুশতাক বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ ও সতর্কতার জন্য বড় ধরনের কোনো ইনেসিয়েটিভ নেওয়া প্রয়োজন যা সিসিক এখন পর্যন্ত নেয়নি। তিনি বলেন, অবৈধ গড়ে ওঠা প্রতিটি বিল্ডিং চেক করতে হবে। সিটি করপোরেশনের অনুমোদনগুলো সঠিক পদ্ধতিতে হয় না। শুধু আশপাশে ৩/৪ ফুট ছেড়ে দিয়ে বিল্ডিং করলেই সেটা ভূমিকম্প প্রতিরোধক হবে না। উপরের অংশ প্রতিরোধক হয়েছে কি না তা দেখতে হবে। যেভাবে বিল্ডিং ডিজাইন করা হচ্ছে তাও সঠিক নয়।

জান যায়, প্রায় এক যুগ আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলঙ্কার একটি বিশেষজ্ঞ দল সিলেট নগরীর ছয় হাজার ভবনের ওপর জরিপ চালিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভবন ধসে পড়বে। এতে ক্ষতি হবে ৮ হাজার কোটি টাকার। প্রাণহানি হবে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষের।

শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক আরঙ্গা পোলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আখতার, অধ্যাপক ড. আপ্তাব আহমেদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাকসুদ কামাল, ড. জাহাঙ্গীর আলমসহ জাপান থেকে আসা আরো দুজন বিশেষজ্ঞ এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন।

গবেষক দলের সদস্য ড. জহির বিন আলম বলেন, ভূমিকম্পের দিক থেকে সিলেট মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাৎক্ষণিক ক্ষতি-হ্রাস ও উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সিলেটে আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের এখনই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

বিশেষজ্ঞরা জানান, হাওর, বিল, খাল-নালা, জলাভূমি ভরাট করে, পাহাড়-টিলা কেটে হাউজিং প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেটে ক্ষতির আশঙ্কা আরো বাড়ছে।

সিসিক সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে সবশেষ সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর ব্যাপারে জরিপ চালানো হয়েছিল। এতে ৩২টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেগুলো তখন ভেঙে ফেলার উদ্যোগও নেয়া হয়। তবে বিভিন্ন জটিলতায় সে কাজ এগোয়নি।

এদিকে সিলেটে মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেও তার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার সক্ষমতা নেই ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সেরও। সিলেট বিভাগের ৩৮ উপজেলার মধ্যে মাত্র ১৪টিতে ফায়ার স্টেশন রয়েছে। সেগুলোতে আবার তেমন কোনো যন্ত্রপাতি নেই।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সিলেটের অনেক বহুতল ভবনই নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদনহীনভাবে। অলিগলির রাস্তাও সরু। ফলে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। এ ব্যাপারে নগর কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।

আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজীব হোসেন জানান, ভৌগোলিক কারণেই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। এ অঞ্চলে ডাউকি, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ানসহ ১০টি ফল্ট সক্রিয় রয়েছে। ৬ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেট বিভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।