খুলনায় আবারও বেড়েছে টার্গেট কিলিং। আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও পুরোনো শত্রুতার জেরে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাকাণ্ড। গত ১৫ মাসে ৪৪ খুনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও হত্যাকাণ্ড যে হারে বাড়ছে, তাতে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গত রোববার রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীর দুটি স্থানে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকায় রাত ৯টার দিকে দুর্বৃত্তরা ঘরে প্রবেশ করে স্ত্রীর সামনে নির্মমভাবে হত্যা করে আলাউদ্দিন মৃধাকে (৩৫)। প্রথমে গুলি, পরে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় তারা। পুলিশের ধারণা, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত টার্গেট কিলিং।
এর কিছু সময় পর নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কালভার্টের পাশে একটি বাড়ির মুরগির খামারের ঘর থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার হয়। নিহতরা হলো—মহিদুন্নেছা (৫৮), তার নাতি ফাতিহা আহমেদ (৬) ও মোস্তাকিম আহমেদ (৮)। তাদের শ্বাসরোধে ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৫ মাসে খুলনায় মোট ৪৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এর মধ্যে চলতি বছরের নভেম্বরে চার, অক্টোবরে চার, সেপ্টেম্বরে এক, আগস্টে পাঁচ, জুলাইয়ে দুই, জুনে তিন, মে মাসে পাঁচ, এপ্রিলে দুই, ফেব্রুয়ারিতে এক এবং জানুয়ারিতে দুটি খুনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো ১৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ সময়ের মধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষ প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন।
পুলিশের দাবি, খুলনার অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘুরেফিরে মাদক কারবারের প্রভাব বিস্তার, পদ-পদবি ধরে রাখা, এলাকা দখল, পুরোনো বিরোধ ও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটে। অনেকে আবার ভাড়াটে সন্ত্রাসী ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ‘অপসারণ’ করছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সামান্য বিরোধ, আর্থিক লেনদেন বা ব্যক্তিগত শত্রুতাও রক্তাক্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছে।
গত এক বছরে খুলনায় বেশকিছু হত্যাকাণ্ড পুরো শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে গত ২৮ অক্টোবর দৌলতপুরে কথিত মাদক ব্যবসায়ী কানা মেহেদীর দুই বাড়িতে দুর্বৃত্তরা ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। ২ অক্টোবর নেশার অর্থ না পেয়ে ছেলে লিমন নিজের বাবা লিটন খানকে শ্বাসরোধ ও গলা কেটে হত্যা করে। ৯ অক্টোবর হাউজিং বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী সবুজ খানকে। ১৭ অক্টোবর ঘরে ঢুকে গুলি করা হয় যুবক সোহেলকে। ৩০ সেপ্টেম্বর জানালা দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবক তানভির হাসান শুভকে। ৩ আগস্ট গলা কেটে হত্যা করা হয় আল আমিনকে। ১ আগস্ট ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান মনোয়ার হোসেন টগর। ১১ জুলাই বাসার সামনে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয় মাহবুবুর রহমানকে। ১৫ মার্চ চরমপন্থি নেতা শেখ শাহীনুল হক শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাত নামলেই অনেক এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। মোটরসাইকেলে করে গুলি ছোড়া, বাড়িতে ঢুকে হামলা, প্রকাশ্য সড়কে কুপিয়ে হত্যা—এসব ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এখন আর কোনো ঝগড়াকেও ছোট করে দেখা যায় না। কখন কী হয়ে যায়, তার নিশ্চয়তা নেই।
কেএমপির উপকমিশনার (দক্ষিণ) সুদর্শন কুমরায় রায় বলেন, খুলনাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মোটরসাইকেল টহল বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে, এর বেশিরভাগই টার্গেট কিলিং। প্রতিটি ঘটনায় আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।