Image description

১০টা হোন্ডা, ২০টা গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এ প্রবাদ চালু রয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ১৬ বছরে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে ১৪০০ তাজা প্রাণ শহীদ হয়েছেন, প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, তাদের পেছনে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বারবার আন্দোলন, সংগ্রাম, জ্বালাও-পোড়াও; তাতে লাখো কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে ও প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য লোকের। এর পেছনে মূল কারণ অস্বচ্ছ, অগ্রহণযোগ্য ও ভুয়া নির্বাচন। তাছাড়া, প্রতিটি নির্বাচনে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। জন্ম হয়েছে ফ্যাসিস্টের যে ২৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে, ব্যাংকগুলো উজাড় করে অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করত, ফ্যাসিস্টের জন্ম হতো না, বারবার এত প্রাণ ক্ষয় হতো না এবং আয়নাঘর, গুম ও ক্রসফায়ারÑএসব শব্দই আসত না।

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, শঙ্কা ততই বাড়ছে। মানুষের মনে প্রশ্নÑশান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে তো? সরকারের প্রস্তুতিতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতের জন্য ফাঁকা আশ্বাস ছাড়া নতুন কিছু দেখছেন না তারা। পুলিশের মনোবল আগেই ভেঙেছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্ভব নয়। সীমিতসংখ্যক সেনাবাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স এর আগে কেন্দ্র দখল থামাতে কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। তাহলে কী হবে সামনের নির্বাচনে?

নির্বাচন ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। এগুলো বাস্তবায়ন হলেও বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করলে সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভোটচুরি হবে। কোনো সংস্কারই কাজ করবে না, যদি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সরকার গঠিত না হয়। নির্বাচন স্বচ্ছ করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপাদান হতে পারে সিসিটিভি, সব কেন্দ্রের সব বুথ সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। হোন্ডা ও গুন্ডার কেন্দ্র দখলের নির্বাচন সামনে ঘনিয়ে আসছে। জানা গিয়েছে, প্রথাগত প্রশাসন তথ্যবিভ্রাটের কারণে অথবা অসদুদ্দেশ্যে ব্যয়ের ধুয়ো ‍তুলে সিসিটিভি লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিচ্ছে। আবার একটা অস্বচ্ছ, অগ্রহণযোগ্য ও ভুয়া নির্বাচন হলে দেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। সরকার দায়িত্বশীল হবে না, আবার দুর্নীতি অর্থনীতিকে কুরে কুরে খাবে, ব্যাংক উজাড় হবে, রাজপথে গাড়ি পুড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামবে, চাঁদাবাজি তুমুলভাবে চলবে।

অথচ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে মাত্র ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করলে আইপি ক্যামেরাসহ সব কেন্দ্র ও সব বুথ সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা যাবে এবং নির্বাচন কেন্দ্রের পুরো ভিডিও হার্ড ড্রাইভে সংরক্ষিত থাকবে। সরকারের অধিকাংশ প্রকল্প যেখানে হাজার কোটি টাকার ওপরে, সেখানে ২০০ কোটি টাকার ব্যয়কে অতিরিক্ত আখ্যা দেওয়া দুরভিসন্ধিমূলক বটে। এছাড়া, একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সিসিটিভি সংগ্রহ বাবদ কোনো ব্যয়ই অতিরিক্ত বিবেচিত হতে পারে না। কারো সন্তান অসুস্থ হলে প্রয়োজনে সব সম্পদ ব্যয় করে নিঃস্ব না হওয়া তিনি চেষ্টা করে যান প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে, তেমনি দেশ যখন ধ্বংস হচ্ছে, তখন ব্যয়ের বাহানা দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া আত্মঘাতী। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।

কাজী রকিবউদ্দীন বা নূরুল হুদা ইতিহাসের পাতায় যে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছেন, তার রেশ না মুছতেই আবার ভোট ডাকাতির নির্বাচন হলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনও একই ভাগ্যবরণ করবেন। এই ব্যর্থতার পরিণাম দেখার জন্য প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টামণ্ডলী বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রশাসনের হাতে জিম্মি হতে পারেন না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সবার মাঠপর্যায়ে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই, তাই হয়তো তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঝুঁকি অনুধাবন করতে পারছেন না। শুধু আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় না, এর বাধাগুলো চিহ্নিত করতে হয় এবং নিশ্ছিদ্র সমাধান করতে হয়।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্র থাকবে। বুথ হবে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯। প্রতি কেন্দ্রে গড় বুথ সংখ্যা হবে প্রায় ছয়টি। প্রতি কেন্দ্রের জন্য ছয়টি আইপি ক্যামেরা, হার্ড ড্রাইভ (৫০০ জিবি) ও মনিটর (১৯ ইঞ্চি)-সহ সিসিটিভি সেটের ইনস্টলেশনসহ সর্বোচ্চ খরচ হবে প্রায় ৫০০ হাজার টাকা। সে হিসেবে সারা দেশের সব নির্বাচনি কেন্দ্র মাত্র ২১৪ কোটি টাকায় সিসিটিভির আওতায় আনা সম্ভব হবে। যেসব স্কুলে বা স্থাপনায় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, সেসব জায়গায় বিদ্যুৎ রয়েছে। সিসিটিভি স্থাপন স্বল্প সময়ে সম্ভব। সিসিটিভি এখন একটি সাধারণ ও সহজলভ্য টেকনোলজি, সব জেলায় পাওয়া যায়। মানুষ বাড়ি বাড়ি লাগায়। সরকার নির্বাচনের জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে। যদি এ বাজেটের মধ্যে সিসিটিভি সংগ্রহের জন্য ২১৪ কোটি টাকা ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে কমিশন আলাদা বাজেট নিতে পারে।

জানা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রতি কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের বিষয়ে একমত হলেও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কাজটি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এটি তার অযোগ্যতার প্রমাণ হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কমিশন অন্য কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে পারেন। তবে তিনি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার এজেন্ডা গ্রহণ করে সিসিটিভি স্থাপনের বিরোধিতা করলে নির্বাচন কমিশনের এখনই সাবধান হওয়া উচিত। কথায় আছেÑ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’।

লেখক : গবেষক