বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও এর প্রশ্নমালা এবং প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণে গণভোটের উল্লেখিত চারটি প্রশ্নের কোনোটিতে হ্যাঁ আবার কোনোটিতে আলাদা করে ‘না’ বলার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। একসঙ্গে চারটি বিষয়েই ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দিতে হবে ভোটারদের। এতে ভোটারদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা হবে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া নিরক্ষর ভোটারদের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের একটি মাত্র ভোট প্রয়োগে জটিলতা তৈরি হতে পারে— এমন শঙ্কার কথাও জানান তারা।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছেন যে, জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়কে একত্রিত করে একটি মাত্র প্রশ্ন ব্যালটে রাখা হবে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া নোট অব ডিসেন্টসহ রয়েছে ঐকমত্য হওয়া ইস্যুগুলোও। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন (পিআর পদ্ধতি) এবং সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর চারটি প্রশ্নমালা, আবার সবগুলো প্রশ্নের একত্রে একটি প্রশ্নে রূপ দিয়ে তার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে জবাবের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ভোটে ‘হ্যাঁ’-এর পাল্লা ভারী হলে আগামী সংসদের সদস্য নিয়ে গঠিতব্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ ১৮০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। আর না জিতলে বাতিল হয়ে যাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা দলগুলোর অঙ্গীকার। ফলে সংসদীয় পদ্ধতিসহ সব কিছুই থেকে যাবে আগের অবস্থায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংক্ষেপে চারটি প্রশ্ন থাকলেও প্রতিটি প্রশ্নে রয়েছে বিস্তারিত অনেক বিষয়। এসব বিষয়ে জনগণকে জানানো ও ভোটে উদ্বুদ্ধ করাই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আর একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় ওই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে চলছে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ। ভোট পদ্ধতি এবং প্রশ্ন বাছাই নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। রাজনৈতিক দলগুলোও গণভোটের প্রশ্নমালা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বিএনপি প্রশ্নমালা নিয়েই গুরুতর আপত্তি তুলেছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন তুলেছেন, গণভোটের চারটি প্রশ্নের কোনো একটির সঙ্গে দ্বিমত থাকলে সেখানে ‘না’ বলার সুযোগটা কোথায়?
রিজভী বলেন, গোঁজামিল দিয়ে কোনো কিছু করা হলেও তা টেকসই হবে না। ৯০ ভাগ মানুষ যদি বুঝতে না পারে গণভোটের উদ্দেশ্য কী, তাহলে সেই একই তিমিরে মানুষ থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে, সেই আলোকে গণভোটের প্রশ্নমালা করার পরামর্শ দেন রিজভী।
বিএনপির এই মুখপাত্র আরও বলেন, গণভোটে যে চারটি প্রশ্ন রয়েছে সেখানে ‘না’ এর অপশন নেই। একমত হতে না পারলে সেই মতামত কীভাবে দেবে জনগণ, তা উল্লেখ নেই গণভোটে।
একটি প্রশ্নে চারটি বিষয়কে একত্রিত করার সমালোচনা করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। তিনি অভিযোগ করেছেন, এটি সংস্কারকে গুরুত্বহীন করার ফাঁদ। একটি মাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট নেওয়ার ফলে ভোটারদের মনোযোগ সংস্কারের বিষয়গুলো থেকে সরে গিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে চলে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণভোটের মূল উদ্দেশ্যই হলো জনগণের চূড়ান্ত রায় নেওয়া। এই রায়কে বৈধতা দিতে হলে প্রশ্নমালা হতে হবে স্পষ্ট, দুর্বোধ্য নয়। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে একটি মাত্র প্রশ্নে গেঁথে দেওয়া হলে তা শেষমেশ জনগণের প্রতি অবিচার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তারা মনে করেন, গণতন্ত্রের স্বার্থেই গণভোটের প্রশ্ন নিয়েও রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। এমনকি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একটিমাত্র প্রশ্নে যুক্ত করায় ভোটারদের পছন্দের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে বলেও মত তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে কতটা আন্তরিকভাবে নিচ্ছে, দ্বিতীয়ত সনদ নিয়ে নেতারা জনগণের মাঝে কেমন প্রচার চালাচ্ছেন, আর সর্বশেষ হলো নাগরিকদের কাছে প্রশ্নগুলো বোধগম্য করতে সরকার কী ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব চ্যালেঞ্জ পার হতে না পারলে বা প্রশ্ন না বুঝলে জনসাধারণ কিন্তু গণভোটে আগ্রহী হবে না। কারণ, সরকার এরই মধ্যে প্রশ্নগুলো জটিল ও কঠিন আকারে উপস্থাপন করেছে। প্রতিটি প্রশ্নের ভেতরে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটাকে আরও সহজ করলে ভালো হতো।’
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘গণভোটে চারটি বিষয় রাখায় এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলাই হবে নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। সেজন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসব প্রশ্ন নিয়ে আগ্রাসী প্রচার চালাতে হবে। বিশেষ করে নিরক্ষরদের জন্য পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বললে কী হবে আর ‘না’ বললে কী হবে, সে সম্পর্কে বোঝাতে হবে।’