Image description
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমসিসির মূল্যায়ন

কার্যকর ২২টি সূচকের মধ্যে ১৬টিতেই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) মূল্যায়নে এই তথ্য দিয়ে সূচকগুলোকে রেড জোনে ফেলা হয়েছে। সরকারের কার্যকারিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকও রয়েছে এ তালিকায়। শুক্রবার এমসিসির নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এতে ‘রেড’ এবং ‘গ্রিন’ জোনের দেশগুলোর অবস্থা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। আশপাশের দেশের তুলনায় কয়েক বছর ধরেই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যদিও গত বছরের তুলনায় একটির উন্নতি হয়েছে এবার। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭টি। এমসিসি’র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযাযী, ২০২৬ সালের স্কোর কার্ডে রেডজোনে থাকা সূচকগুলো হচ্ছে-গভর্নমেন্ট ইফেকটিভনেস (সরকারের কার্যকারিতা), কন্ট্রোল অব করাপশন (দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ) এবং গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিট (সরকারের জবাবদিহিতা)। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, বাণিজ্য নীতিমালা, ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (তথ্যের স্বাধীনতা), অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয়, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, আইনের শাসন এবং শ্রমশক্তির উন্নয়ন। আরও আছে ঋণ প্রাপ্তি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশগম্যতা, মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার এবং শিশুস্বাস্থ্য। অপরদিকে গ্রিন জোনে থাকা সূচকগুলো হলো-মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও ভূমি অধিকার, বিজনেস স্টার্টআপ, বাজারের প্রতিযোগিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ক্রনিক ডিজেস (দীর্ঘমেয়াদি রোগ)।

প্রতিবেদনে মোট ২২ সূচকের মধ্যে ৬টি রয়েছে গ্রিন জোনে। এতে দেখা যায়, ভারতের রেড জোনে রয়েছে ৭টি সূচক, পাকিস্তানের ১২টি, ভুটানের ৮টি, নেপালের ২টি এবং শ্রীলংকার ৬ সূচক।

এমসিসি মূল্যায়নে বাংলাদেশ রেডজোনের সূচক প্রসঙ্গে শনিবার কথা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতিসহ যেসব বিষয় লাল তালিকায় রয়েছে সেগুলো দীর্ঘ ৫৪ বছরের জঞ্জাল। গত ১৬ বছরে এসব জঞ্জাল চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েছিল। ফলে এক-দেড় বছরের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে স্কোরের উন্নতি প্রত্যাশা করা গেলেও তা যৌক্তিক হবে না। স্বল্প সময়ে এই সরকার যেসব কৌশল নিয়েছে সেগুলোও যে খুব বেশি কার্যকর হয়েছে তা বলা যায় না। তবে ইতিবাচক ছিল বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে সুপারিশ নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ। তবে সুপারিশের ভিত্তিতে যেসব অধ্যাদেশ জারি করা হয় সেগুলোর বাস্তবায়ন ও অধ্যাদেশগুলোতে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। অনেক বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেও সরকারকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদসহ সবার সম্পদের হিসাব দেওয়ার একটা উদ্যোগ ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলেও এমসিসির স্কোরে প্রভাব পড়ত।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্কোরে পিছিয়ে থাকার ফলে এবারও মিলছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) মোটা অঙ্কের অনুদান সহায়তা। স্কোর কার্ডের উন্নতির ভিত্তিতে কোনো দেশকে এই ফান্ডে যুক্ত করা হয়। ইআরডি’র পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর চেষ্টার পর এখন হাল ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুদান বড় কথা নয়, এ প্রতিবেদনের সঙ্গে দেশের সম্মান জড়িত। তাই ইআরডির বসে থাকার সুযোগ নেই।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর আগে ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে ২০টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭টি সূচক ছিল রেড জোনে। এছাড়া ২০২৩ সালে ছিল ১৭টি, ২০২২ সালে ১৬টি, ২০২১ সালে ১৩টি, ২০২০ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ছিল ১১টি এবং ২০১৮ সালে রেড জোনে ছিল ৭টি সূচক।

ইআরডি’র সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম যুগান্তরকে বলেন, ট্রাম্পের নতুন সহায়তা নীতির কারণে হয়তো অনুদান পাওয়াটা কঠিন। কিন্তু এ বিষয়টির সঙ্গে শুধু অনুদান পাওয়া বা না পাওয়াই নয়, এই স্কোরের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও নির্ভর করছে। তবে এই মূল্যায়নের সঙ্গে রাজনীতিও যুক্ত রয়েছে। স্কোর উন্নতিতে ইআরডির তেমন কিছুই করার থাকে না। এর উন্নতিকল্পে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। এছাড়া আমাদের দেশে সুশাসনের যে ঘাটতি রয়েছে তা পূরণ করতে হবে।

ইআরডি সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে এবং এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। এই ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এমসিএফ-এর আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অঙ্কের সহায়তার দেশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অঙ্কের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। এই ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতিবছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। কোনো দেশকে মূল্যায়নের জন্য প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন নির্দেশকসহ মোট ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। এখন ২০২৬ সালে এসে দুটি সূচক বাড়িয়ে ২২টি করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি বাংলাদেশ সফরে এলে ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে তখন অনুরোধ জানানো হয়। পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধিরা। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছিল-যা এই সূচকের সঙ্গে সম্পর্কিত।