Image description
ঢাকার এমআরটি প্রকল্পগুলোতে আন্তর্জাতিক মান পূরণকারী দেশ থেকে উপকরণ আমদানি করা হয়

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ হচ্ছে ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে নিরাপদে এবং সময়মতো বাস্তবায়ন করা। শহরের তীব্র যানজট লাঘব করে যোগাযোগের সেবা নিশ্চিত করা। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় সংকোচনের অজুহাতে নেয়া পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় চুক্তিসম্পাদন বিলম্বিত করতে পারে। এই পদক্ষেপ প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এতে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন মেট্রোরেল সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি লাইন-১ এবং লাইন-৫ নর্থ-এর ডিএমটিসিএল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ টেন্ডারের বিড ভ্যালিডিটি সময়সীমা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। প্রকল্পের খরচ প্রতিযোগিতামূলক বিডিংয়ের মাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপন করাও হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালে তৈরি করা প্রাথমিক সম্ভাব্যতা প্রতিবেদনের ওপরে ভিত্তি করে প্রস্তুতকৃত উচ্চ খরচের সাথে বা ভারতীয় প্রকল্পগুলোর সাথে প্রকল্পের বর্তমান খরচের তুলনা করা হচ্ছে। এসব তুলনা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, ঢাকার মেট্রোরেলের জটিল কাজের পরিবেশ, ভূতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ, অন্তর্নিহিত ঝুঁকি এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে পরিবেশকে উপেক্ষা করে। চূড়ান্ত নকশায় এ প্রকল্পের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন হয়েছে যা ২০১৯ সালে অনুমোদিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। খরচ কমানোর অজুহাতে বিডের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়লে প্রকৃতপক্ষে খরচ সাশ্রয় হবে না। এতে চুক্তি সম্পাদন বিলম্বিত হলে সামগ্রিক খরচ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাৎক্ষণিক খরচ কমানোর জন্য চুক্তির পরিধি সংকুচিত করা হলে ভবিষ্যতে লাইনগুলো তৈরি হওয়ার পর এগুলোর কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ডিএমটিসিএলের সাথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তুলনা করাও মূলত ভুল। বিমান একটি প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যিক পরিবেশে পরিচালিত হয়। যেখানে লাভ বৃদ্ধি ও বাজার দখলের জন্য প্রবাসী কর্মীদের নিয়োগ করা হয়। ঢাকা মেট্রোরেল একটি জনসেবামূলক প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য হলো সড়কের যানজট কমানো। শহরের মানুষের চলাচল উন্নত করা। মেট্রোরেল নাগরিকের জন্য একটি লাইফলাইন। রাজধানীর নাগরিকরা প্রতিদিন দীর্ঘ যানজটে অজস্র কর্মঘণ্টা হারান যা দেশের উৎপাদনশীলতাকে দারুণভাবে ব্যাহত করে। বিলম্ব মানেই উচ্চতর খরচ নগর উন্নয়নের সুযোগ হাতছাড়া করা যা যানজটপূর্ণ সড়কের উপর ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত চাপ। খরচ হ্রাসের পদক্ষেপ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেগুলি সঠিকতা এবং ন্যায্যতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যান্য প্রকল্পগুলোর সাথে ভুল তুলনা করে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা উচিত নয় বলে জানিয়েছেন তারা।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-১) সাবেক প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কাশেম ভূঁঞা জানিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে ঢাকা মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-১ প্রকল্পের ব্যয় ভারত ও অন্যান্য দেশের মেট্রো প্রকল্পের তুলনায় অতিরিক্ত বেশি। প্রকল্প ব্যয়ের প্রকৃত প্রযুক্তিগত, নগর ও আর্থিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে এবং প্রমাণ করে যে ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় নির্মিত পাতাল মেট্রো প্রকল্পগুলোর আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে ঢাকা এমআরটি লাইন-১ এর ব্যয় সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ও পণ্য স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়, যেখানে ঢাকার এমআরটি প্রকল্পগুলোতে আন্তর্জাতিক মান পূরণকারী দেশ থেকে এসব উপকরণ আমদানি করা হয়। তাই এই ব্যয়ের তুলনা করলেই বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয় না। প্রতি কিলোমিটার ব্যয় তুলনার মাধ্যমে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা বিভ্রান্তিকর। কারণ এতে পাতাল অংশের অনুপাত, প্রকৌশলগত জটিলতা ও ভূতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জগুলো উপেক্ষা করা হয়। বর্তমান ব্যয় আন্তর্জাতিক নির্মাণ ব্যয় স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং প্রকল্পটি পরিকল্পনা অনুযায়ী চলা উচিত।

তিনি বলেন, ঢাকা এমআরটি লাইন-১ যার একটি বড় অংশ পাতাল এর সঙ্গে ভারতের বা উপসাগরীয় দেশের মূলত উড়াল বা স্থলভিত্তিক মেট্রোর তুলনা করেছে। বিশ্বব্যাপী পাতাল মেট্রো লাইনের ব্যয় উড়াল লাইনের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি। দিল্লি মেট্রোর ফেজ-৩ এর পাতাল অংশের ব্যয় ছিল প্রতি কিলোমিটারে ১৮০-২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ঢাকার সঙ্গে তুলনীয়। তাই পাঁচ গুণ বেশি এমন দাবি প্রকৌশলগতভাবে ভুল ও বিভ্রান্তিকর। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী। এমন পরিবেশে নির্মাণ কাজ পরিচালনা করতে জটিল যানবাহন ডাইভারশন, ইউটিলিটি স্থানান্তর, ভূমি পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন। শহরটির নরম পলিমাটি এবং হাই ওয়াটার টেবিল টানেল নির্মাণকে ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তিগতভাবে কঠিন করে তোলে। ফলে ধারাবাহিক মাটির উন্নয়ন ও পানিরোধী ব্যবস্থা প্রয়োজন।

ঢাকা এমআরটি লাইন-১ এর ৩১ কিলোমিটার ২১ স্টেশন এরমধ্যে ১৬ দশমিক ৩২ কিলোমিটার পাতাল এবং ১১ দশমিক ৪ কিলোমিটার উড়াল অংশ অন্তর্ভুক্ত। এতে গভীর ইন্টারচেঞ্জ স্টেশন, সরাসরি বিমানবন্দর সংযোগ, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত সিবিটিসি সিগন্যালিং ব্যবস্থা রয়েছে। নতুন বাজার স্টেশনটি ৬০০ মিটারেরও বেশি দীর্ঘ যা পাতাল ও উড়াল লাইনের সংযোগ বিন্দু। এ ধরনের স্টেশনের নির্মাণ ব্যয় সাধারণ পাতাল স্টেশনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ভারতের মেট্রো প্রকল্পগুলো প্রায়শই রাজ্য সরকার-সহায়িত ভূমি, দেশীয় ঠিকাদার ও কর-ছাড় সুবিধা পায়। বাংলাদেশে জাইকা অর্থায়িত প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক এফআইডিআইসি মান, জাপানি শিল্পমান, এবং কঠোর নিরাপত্তা ও পরিবেশগত মানদ- অনুসরণ করে। ফলে প্রাথমিক মূলধন ব্যয় বেশি হলেও প্রকল্পের স্থায়িত্ব ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত হয়।

তিনি আরো বলেন, ঢাকা এমআরটি প্রকল্পের প্রি-কোয়ালিফিকেশন পর্যায়ে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ইতালি, তুরস্ক, কোরিয়া ও জাপানের বহু প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কঠোর প্রযুক্তিগত, নিরাপত্তা ও অভিজ্ঞতা মানদ-ের কারণে ভূগর্ভস্থ অংশে কেবল অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা অর্জন করে যাদের মধ্যে জাপানি কোম্পানিগুলো শীর্ষে ছিল। তবে উঁচু অংশে বিভিন্ন দেশের ঠিকাদার যোগ্যতা অর্জন করেছে। শুধু জাপানি প্রতিষ্ঠানই অংশ নিতে পারে এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল। জাইকা স্থানীয় সক্ষমতা গঠনে যৌথ উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এমআরটি লাইন-১ এর নকশা আয়ু ১০০ বছর, যা নিরাপদ, নিম্ন-কার্বন নিঃসরণ পরিবহন সুবিধা প্রদান করবে। প্রকল্পটি যানজট, বায়ুদূষণ ও যাতায়াত সময় কমিয়ে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি অবদান রাখবে।

২০১৯ সালে প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ছয় দশমিক চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২৫ সালে বেড়ে আট বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো স্থানীয় অদক্ষতা নয় বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। বিশ্বব্যাপী মহামারি-পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি, সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘœ ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে অবকাঠামো ব্যয় ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। স্টিল, সিমেন্ট, তামা ও অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়ে বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক পরিবহন খরচ বেড়েছে।

বাংলাদেশি টাকার মান ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। একই সময়ে জাপানি ইয়েন ও ইউরোর অস্থিরতা আমদানিকৃত সরঞ্জামের খরচ ও অর্থায়ন ব্যয়কে প্রভাবিত করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত-পরবর্তী জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধিও নির্মাণ উপকরণের খরচ বাড়িয়ে দেয়। ২০১৯ সালের পর বন্যা প্রতিরোধ, ভূমিকম্প সহনশীলতা, বায়ু চলাচল ও অগ্নি নিরাপত্তা উন্নয়নের মতো নকশা ও নিরাপত্তা উন্নতি যুক্ত হওয়ায় ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঢাকা এমআরটি লাইন-১ এশিয়ার অন্যতম চ্যালেঞ্জপূর্ণ নগর ও ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে নির্মিত একটি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও নিরাপত্তা-সমৃদ্ধ প্রকল্প। এর ব্যয় কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটির ব্যয় যৌক্তিক ও ন্যায্য। তাই এটি পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে নেয়া অত্যাবশ্যক যাতে বাংলাদেশের জনগণের জন্য টেকসই, আধুনিক ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।