২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) এর নাম বদলে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এবং তাদের পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা, কাঠামো ও আস্থার বড় সংকট মোকাবিলা করার কথা জানানো হয়েছিল। ২০২৪ সালে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের ঘটনা, উভয়পক্ষের ভয়াবহ দৃশ্যমান সহিংতার কারণেও বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের দাবি ওঠে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ঘটনার পর বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইউনিফর্ম পরিবর্তনকে ‘রিব্র্যান্ডিং’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু শুধু পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসলে মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয় না। তারপরও বড়সড় কোনও ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যুক্ততা থাকলে বাহিনীর পোশাক (ইউনিফর্ম) পরিবর্তনের দাবি বা আলোচনা ওঠে। মনোরোগ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর পেছনে কয়েকটি বাস্তব, মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত কারণ আছে। বড় ঘটনা দল বা বাহিনীর সদস্যদের ওপর মানসিক চাপ ফেলে। ইউনিফর্ম পরিবর্তন অনেক সময় নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে কাজ করে এবং সদস্যদের মধ্যে আস্থা বাড়ায়।
বদলে গেলো পুলিশের পোশাক
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তারা জলকামান, বন্দুক, টিয়ার গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করেছে। কখনও কখনও টার্গেট কিলিংয়েরও অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার এর বিপরীতে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে, থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একটার পর একটা, যেখানে-সেখানে গায়ের পোশাক ফেলে পালাতে হয়েছে অনেক পুলিশ সদস্যকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম প্রধান দাবি হয়ে ওঠে, বদলাতে হবে বাহিনীর পোশাক। প্রায় দেড় বছর পর বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা পুরোনো পোশাক ছেড়ে শনিবার (১৫ নভেম্বর) থেকে নতুন পোশাক পরা শুরু করেছেন। সব সদস্যের জন্য এখনও পোশাক তৈরি না হওয়ায় সীমিত পরিসরে এই পরিবর্তন কার্যকর হয়েছে।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং বিশেষ কিছু ইউনিটের সদস্যরা নতুন পোশাক পাচ্ছেন। পরে ধাপে ধাপে পুলিশের বাকি সদস্যদের কাছেও নতুন পোশাক পৌঁছে যাবে।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মনে করেন, শুধু পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয় না। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মৌলিক পরিবর্তন যদি না ঘটে তবে পুলিশের মেরুদণ্ড শক্ত হওয়া বা ঘুরে দাঁড়ানোর মতো ঘটনাগুলো ঘটবে না। পোশাক পরিবর্তনের প্রভাব একদম পড়ে না তা নয়, কিন্তু প্রভাবের মাত্রাটা এতই সামান্য যে সেটা ধর্তব্যে নেওয়া হয় না। পুলিশ প্রশিক্ষণ, পুলিশের কাজ করার পরিবেশ, পুলিশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়োগ এসবে যদি পরিবর্তন না আসে, তবে তার মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আসবে না। আর পরিবর্তন না এলে পোশাক বদলে দিয়ে যে চেষ্টাটা করা হচ্ছে তা কার্যকর নাও হতে পারে।’
কেন বিডিআর এর নাম ও পোশাক বদলেছিল?
ভয়াবহ বিদ্রোহের পর প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছিল। ২০০৯ সালে পিলখানায় বিপুলসংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এই ঘটনার ফলে বিডিআর নামে বড় ধরনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। তাই পুরোনো নামটি বদলে নতুন পরিচয় দেওয়া হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।
সে সময় যৌক্তিকতা বোঝাতে বলা হয়েছিল, নতুন নাম বাহিনীর সদস্যদের জন্য মানসিক পুনরুত্থান হিসেবে কাজ করে এবং পোশাক ও নাম পরিবর্তন করলে ‘নতুন পরিচয়’, ‘নতুন শুরুর’ অনুভূতি তৈরি করা সম্ভব হবে। পুরোনো বিডিআর এর পরিচয়ের সঙ্গে যা যা নেতিবাচক স্মৃতি তৈরি হয়েছে সেসব দূর করতে, শত শত পোশাক রাস্তাঘাটে পড়ে থাকার যে মানসিক ট্রমা; সেটা দূর করতে এর বিকল্প ছিল না বলে জানানো হয়েছিল। ফলে যেকোনও বাহিনীর ইউনিফর্ম যেহেতু তার পরিচয়, দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার প্রতীক; নতুন নামের সঙ্গে মানানসই নতুন রঙ, ব্যাজ ও লোগো দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিচয় সৃষ্টি করা হয়।
কেন একেকটা বড় ঘটনার পর পোশাক বদলাতে হয়? প্রশ্নের জবাবে বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পোশাক বদলাতে হয় এমন না। হয়তো মনে করা হয় পোশাক বদলানোর মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের আচরণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব।’
কিন্তু শুধু পোশাক বদলে আসলে কোনও পরিবর্তন সাধিত হয় কিনা সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনের ব্যবস্থা করছি কিনা সেটা দেখতে হবে। জনগণের সেবক হতে হলে যে ধরনের আচরণগত পরিবর্তন দরকার সেটা এখনও লক্ষ্য করছি না। সিটিজেনদের আইনের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখানোর কথা, সেটাও দেখছি না। ফলে পোশাক পরিবর্তন করলে এটা গ্রহণযোগ্য ও সভ্য হয়ে যাবে এমন না। উভয় পক্ষেরই নানাবিধ মোটিভেশনের দরকার আছে।’
পোশাক পরিবর্তনের বিষয়ে বড় ধরনের ব্যবসা জড়িত বলে মনে করেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, “এর সঙ্গে অনেক স্টেক হোল্ডার জড়িত। সেনাবাহিনীতে আগে খাকি পোশাক ছিল, পরে কমব্যাট এলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর মধ্য দিয়ে একটা ‘ইমোশনাল চেঞ্জ’ হলো।” এর সঙ্গে একটা বিজনেস কমিউনিটিও জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ব্যাখ্যার অনেকগুলো ধরন এখানে থাকতে পারে। তবে আমার মনে হয় না, শুধু পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশেষ কোনও পরিবর্তন সম্ভব। দেশের এই ট্রানজিশনাল মুহূর্তে যেন কোনও বিভেদ তৈরি না হয় সেদিকে আমাদের সবার লক্ষ্য রাখতে হবে।’
কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিষয়ে আমাদের যে পূর্বধারণা থাকে সেটা পরিবর্তনে পোশাক পরিবর্তনের একটা গুরুত্ব আছে উল্লেখ করে মনোরোগ চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মনস্তাত্ত্বিক একটা প্রভাব আছে বটে, কিন্তু এটার পাশাপাশি আরও কাজ করতে হবে। বাহিনীর পোশাক, লোগো পরিবর্তনটা প্রতীকী। যথাযথ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তার আচরণগত পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।’