কিশোরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা শামীম মিয়া (২৫)। তিনি সেই ১৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর একজন, যারা গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মালয়েশিয়া যেতে নিয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফেরতে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের মালয়েশিয়া যেতে না পারার কারণ ছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পন্ন করতে না পারা ও ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়া।
শামীম দালালদের হাতে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তবে মালয়েশিয়া যেতে না পারলেও তিনি ফেরত পান মাত্র ২ লাখ টাকা। এখন তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে দ্বিতীয়বার মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ দফায় তাকে আবার ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
মালয়েশিয়া গত বছরের ৩১ মে পর্যন্ত ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির ('সিন্ডিকেট' নামে অধিক পরিচিত) মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অনেক প্রার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিশ্চিত করার পরেও শেষ মুহূর্তে এজেন্সিগুলো ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে হাজার হাজার কর্মী আর মালয়েশিয়া যেতে পারেননি।
ওই সময় থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। তবে সরকার বিশেষ জি-টু-জি ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব কর্মীকে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছে।
শ্রমিক ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, আগের নিয়োগের সঙ্গে দালালেরা ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল। এছাড়াও এতে টাকাও অনেক লাগতো, যা সরকার নির্ধারিত ৭৯ হাজার টাকার চেয়ে অনেক বেশি।
'আমি ৮ মাস আগে বিএমইটিতে (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) অভিযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা আমাকে ডাকেনি। এর মধ্যে তিন মাস পরে একবার খোঁজ নিতে যাই। সালিশের জন্য ডাকা হবে বলা হলেও পরে আর ডাকেনি', টিবিএসকে বলেন শামীম।
শামীম একা নন। যারা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রথম ধাপে মালয়েশিয়া ৭ হাজার ৮৮৩ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেছে। বোয়েসেল আবেদন পুনরায় চালু করলে প্রায় ৪ হাজার আবেদন পড়ে এবং ২ হাজার ৯০০ জনের নাম মালয়েশিয়ার বৈধ তালিকায় থাকায় তারা নির্বাচিত হন। বর্তমানে তারা বোয়েসেলের আওতায় নির্মাণ খাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
কিন্তু ইতিপূর্বে দালালদের ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা দেওয়ার পর এখন আবারও তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। সরকার প্রথমে বলেছিল যে যারা যেতে পারেনি, তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে বা রাষ্ট্রীয় খরচে তাদের পাঠানো হবে।
বাস্তবে অনেকেই কিছুই পায়নি। কেউ কেউ স্বল্প পরিমাণ অর্থ ফেরত পেয়েছেন। আর মালয়েশিয়া যাদের নাম অনুমোদন করেছে, তাদের সবাইকে এখন ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা জমা দিতে হচ্ছে।
অভিবাসী অধিকারকর্মী ও ডব্লিউএআরবিই ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, 'সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল দায়ী এজেন্সির কাছ থেকে শতভাগ টাকা আদায় করা। কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার চাইলে অনেক রকম সোর্স থেকেই এসব কর্মীর টাকা দিতে পারত।'
'ওয়েজআর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড থেকে চাইলে এসব কর্মীদের খরচ দেওয়া যেত, যদিও তা শ্রমিকেরই টাকা। এছাড়া ব্যাংকগুলোর সিএসআর ফান্ডসহ নানামুখী উৎস থেকে প্রতারণার শিকার এই কর্মীদের সহায়তা করা যেত', যোগ করেন তিনি।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও একই কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'যেসব এজেন্সি এসব কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের যদি লাইসেন্স বাতিলের শর্ত দিয়ে একটা ডেডলাইন দেওয়া যেত, তাহলে তারা হয় পুরো টাকা ফেরত দিত, অথবা এসব কর্মীকে যেভাবে হোক পাঠাতে বাধ্য হতো।'
কেন কর্মীদের আবার টাকা দিতে হলো?
বোয়েসেলের মহাব্যবস্থাপক নূর আহমেদ বলেন, 'এমপ্লয়ার পে মডেল অনুযায়ী শুরুতে চেষ্টা করা হয়েছিল, তারা যাতে ফ্রি অব কস্ট যেতে পারে। কিন্তু এভাবে কয়েক মাস অপেক্ষার পর মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।'
'যেহেতু চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তালিকাভুক্ত সবাইকে পাঠানোর সময়সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে, তাই আমরা অপেক্ষা না করে ন্যূনতম খরচে কর্মীদের পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি', যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'ডিসেম্বরের মধ্যে সবাইকে পাঠাতে হবে—এই কারণে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় ন্যূনতম খরচে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'
২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে সরকারি খরচ ছিল ৭৯ হাজার টাকা, সেখানে ১০০ এজেন্সির এই সিন্ডিকেট কর্মীপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছিল।
নূর আহমেদ জানান, 'নিয়োগদাতাদের প্রায় ১ লাখ টাকার মতো খরচ থাকে। এর বাইরে বিমান ভাড়া ও মেডিকেলের খরচ আছে। সাধারণত আমরা সার্ভিস চার্জ নিই। কিন্তু মালয়েশিয়াগামী এসব কর্মীর কাছ থেকে এক টাকাও নিচ্ছি না; বরং অতিরিক্ত খরচও বোয়েসেল বহন করছে।'
নতুন করে যে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে মালয়েশিয়ার এজেন্ট ফি ৭৫ হাজার টাকা, বিমান ভাড়া ৪৫ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ ফি সাড়ে ২২ হাজার টাকা, মেডিকেল খরচ ১০ হাজার টাকা এবং সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত খরচ ১০ হাজার টাকা।
মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা যা বলছেন
মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু পাবনার আব্দুল বাতেন বলেন, 'আগে দালালকে ৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। সব ঠিকঠাক থাকার পরেও যেতে পারিনি। পরে দালাল ২ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এখন বোয়েসেলের মাধ্যমে সুযোগ পাওয়ায় আবার টাকা দিতে হয়েছে। আমি ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা জমা দিয়েছি এবং এখন নির্মাণ খাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।'
আলমগীর নামের আরেক কর্মী বলেন, 'যারা বোয়েসেলের মাধ্যমে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছিল, তাদের প্রথমে বলা হয়েছিল ৭৮ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া নেওয়া হবে। পরে সেটা বাড়ানো হয়। আগে যারা দালালের কাছে টাকা দিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখনো পুরো টাকা ফেরত পায়নি। তবু আবার টাকা জমা দিতে হচ্ছে।'
প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন বোয়েসেলের প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন এবং সবাই টাকা দিয়েছেন। আরও ৫০০ জন প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। তারাও টাকা জমা দিয়েছেন।
আলমগীর বলেন, 'বয়সসীমা ও কাগজপত্রের কারণে অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে বয়সসীমা ছিল ১৮ থেকে ৪৫ বছর। এখন সেটা ২০ থেকে ৪০ বছর। এতে দেড় থেকে ২ হাজার জন বাদ পড়েছেন।'
তার অভিযোগ- 'আগে যারা টাকা দিয়েছিল, তাদের ১০ শতাংশও ফেরত পায়নি। আমি নিজে চার লাখ টাকা দিয়েছিলাম। পরে অভিযোগ করার পর দুই লাখ টাকা ফেরত পেয়েছি। আমার মতো অনেকেই আংশিক টাকা পেয়েছেন, কিন্তু বেশিরভাগই এক পয়সাও ফেরত পাননি।'
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার নির্ধারিত সময়সীমার আগে বিএমইটি ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দিয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কর্মী যেতে পারেননি। এসব কর্মী যেতে না পারায় এজেন্সিগুলোর পুরো টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।
অর্থ ফেরত পাওয়া কতদূর?
মালয়েশিয়া যেতে না পারা এই ১৮ হাজার কর্মীর কয়জন পুরো বা অর্ধেক টাকা ফেরত পেয়েছেন, সে বিষয়ে জানতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি ও বায়রার সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তবে কেউই জানাতে পারেনি কতজন পুরো বা অর্ধেক টাকা ফেরত পেয়েছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী ওই সময় বলেছিলেন, 'এই পুরো বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হয়েছিল। যতটুকু স্মরণে আছে যে বায়রার সদস্যরা বিষয়টিকে পজিটিভলি রেসপন্স করেছিল। শতভাগ হয়ত ক্ষতিপূরণ পায়নি, তবে সদস্যরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো কাজ করেছে।'
বায়রার বর্তমান মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমি বিষয়টি জানি না, স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।'
বিএমইটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, 'অনেক কর্মী উভয় দপ্তরেই অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা কোনো অভিযোগ ফেলে রাখিনি।'
তিনি জানান, কতজনকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানাতে আরও সময় লাগবে।
মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট উইংয়ের যুগ্মসচিব এজেএম নুরুল হক বলেন, 'মোট কতজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, সেটার কোনো তালিকা এখন নেই। ফাইলগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, আরও কাজ প্রয়োজন।'
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সিনিয়র সচিব নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভি করেননি।