সমবায় অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে এক যুগের বেশি সময় ধরে কর্মরত শতাধিক কর্মচারীর নাম পদোন্নতির তালিকায় উঠলেও শেষ পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ঘুষ না দেওয়ায় পদোন্নতির প্রতিবেদনে নানা ভুল ও জটিলতা দেখিয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে—এমন দাবি করে ক্ষোভ জানিয়েছেন বঞ্চিতরা।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সহকারী পরিদর্শক, উচ্চমান সহকারী, প্রধান সহকারী, সহকারী প্রশিক্ষক, মহিলা সহকারী পরিদর্শক, লাইব্রেরিয়ান, টাইপিস্ট, ট্যাবুলেটর, তাঁত বিশেষজ্ঞ, বাংলা অনুবাদক ও টেক্সটাইল ডিজাইনারসহ দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন দুই শতাধিক কর্মচারী। এর মধ্যে ১৪০ থেকে ১৪৫ জনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের থেকে পরিদর্শক, মহিলা পরিদর্শক, প্রশিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে থেকে শতাধিক ব্যক্তির পদোন্নতি দেওয়ার কথা; কিন্তু ঘুষের টাকা না দেওয়ায় নানা জটিলতা দেখিয়ে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, সমবায় অধিদপ্তর অতিরিক্ত নিবন্ধক হাফিজুল হায়দার চৌধুরী, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ (উপসচিব) কল্যাণ চৌধুরী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বরমান হোসেন, উপপরিচালক পিএসসি আসলাম হোসাইন, সমবায় অধিদপ্তর উপনিবন্ধক (প্রশাসন) মুহাম্মদ তানিম রহমানের সমন্বয়ে পদোন্নতির জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু পদোন্নতির প্রতিবেদনে তানিম রহমান একা স্বাক্ষর করেছেন এবং ভুলে প্রতিবেদন দেওয়ায় পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা প্রত্যেকের কাছে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা করে ঘুষ দাবি করেন তানিম রহমান। ঘুষের টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার উপসহকারী নিবন্ধক আমিনুল ইসলামকে। ঢাকার বাইরে ঘুষের টাকার সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় শরীয়তপুর জেলার সহকারী পরিদর্শক আব্দুল ওয়াহেদকে। তারা উপনিবন্ধকের নির্দেশে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা দাবি করেন। হাতেগোনা কয়েকজন টাকা দিতে রাজি হলেও অধিকাংশ কর্মকর্তা অপারগতা প্রকাশ করলে তাদের পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়।
কমিটির মিটিংও করা হয়নি।
তাঁত বিশেষজ্ঞ ইমন সরদার কালবেলাকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছি। আমার জুনিয়রের পদোন্নতি হয়েছে; কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়নি। এখন তাকেই স্যার বলতে হয়। ৮৭ জনের তালিকা করা হলেও প্রতিবেদনে ভুলভাল করে জটিলতা দেখিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। টাকা না দেওয়াই হয়তো কারণ।’
সহকারী পরিদর্শক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘পদোন্নতি হবে শুনেছিলাম; কিন্তু হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তালিকাও করা হয়েছিল। কেউ কেউ বলছে টাকা দিতে হয়; কিন্তু আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই, কাউকে টাকা দিইনি।’
এ অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে আমিনুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
সহকারী পরিদর্শক গোলাম মাওলা বলেন, ‘১২ বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছি। আমার জুনিয়র পদোন্নতি পেয়েছে, আমি পাইনি। এখন শুনছি একটি তালিকা করা হলেও নানা জটিলতা দেখিয়ে তা বন্ধ রাখা হয়েছে। শুনেছি অনেকে টাকা দিয়েছে; কিন্তু আমি দিইনি।’
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২৪ জন গণস্বাক্ষর করে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। গত ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ডিপিসি সভায় ১০০ জনের পদোন্নতির কথা বলা হলেও উপনিবন্ধক তানিম রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি যুগ্ম নিবন্ধক (প্রশাসন) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের নাম ব্যবহার করে পদোন্নতির তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা নিয়েছেন। এমনকি কয়েকজন কর্মচারীর স্বাক্ষর জাল করে বেনামে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্র ডিজির কাছে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তানিম রহমান নিজেই ডিজির নামে পাঠানো চিঠি খুলে পড়েন এবং নিজের কাছে রেখে দেন বলে জানা যায়। বিষয়টি প্রকাশ পেলে তিনি তোপের মুখে পড়েন।
পদোন্নতি কমিটির সভাটি শুধু সহকারী পরিদর্শক ও সমমানের পদগুলোর জন্য আহ্বান করা হলেও অভিযোগপত্রে অফিস সহকারী ও অফিস সহায়কদের স্বাক্ষর যুক্ত করা হয়। পদোন্নতি কমিটির সদস্যরা যখন নৈতিকতার প্রশ্নে বেনামি অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের প্রস্তাব দেন, তখন তানিম রহমান সভা ত্যাগ করেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়া আসবাব, কম্পিউটার সামগ্রী, প্রশিক্ষণ ব্যয় ও অফিস ভ্রমণ খাতে জালিয়াতি করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম প্রকল্পের আওতায় গাভি পালন ও সবজি চাষ প্রশিক্ষণ বাবদ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও করা হয়। কিশোরগঞ্জ জেলা সমবায় কার্যালয়ের বিভিন্ন জিনিসপত্রের কেনাকাটায় অনিয়ম করার অডিট আপত্তি দেখানো হয়েছে জানা যায়।
অভিযোগের বিষয়ে উপনিবন্ধক (প্রশাসন) তানিম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমার অফিসের কিছু লোক এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। যেহেতু পদোন্নতির অনিয়মের বিষয়ে লিখিত চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং আমার কাছে এসেছে, কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি দেখতে পারি।’
সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘যে চিঠির কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়ায় বেনামে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ বা চিঠি ডিজির বরাবর দেওয়ার নিয়ম; কিন্তু তা উপনিবন্ধক কাছে দেওয়া অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য।’
সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুনিমা হাফিজ কালবেলাকে বলেন, পদোন্নতির একটি নিয়ম আছে। পদোন্নতি কমিটি মিটিং করেছে, কিছু কাগজপত্র অসম্পূর্ণ পেয়েছে, সেগুলো ঠিক করেই পরবর্তী সভায় পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেবে।