আন্তর্জাতিক রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ২০২৫ সালের ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন মিশন পরিচালনা করে। মিশন শেষে তারা একটি মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ৫ই নভেম্বর। এতে বলা হয়েছে, এই মিশনটি ছিল আন্তর্জাতিক নীতি ও নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত। দেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেতারা বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসমূহ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি কমিশনের মাধ্যমে একটি উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছে। এর চূড়ান্ত রূপ হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ’, যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ছুঁয়ে যায় এমন ৮৪টি প্রস্তাবনা নিয়ে গঠিত একটি বিস্তৃত নথি।
যদিও এই চার্টারটি বহুলভাবে সমর্থিত হয়েছে, তবু এর বাস্তবায়ন এখনো অনিশ্চিত। কারণ প্রক্রিয়াগত অস্পষ্টতা এবং সময় ও প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ রয়ে গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ভোটার অংশগ্রহণ ও নির্বাচনী কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা। নির্বাচন নিরাপত্তা জোরদারের জন্য কমিশন সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচন নিরাপত্তা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে। তবে এসব পদক্ষেপের পরও প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি এখনো নাজুক-রাজনৈতিক সহিংসতার বিচ্ছিন্ন কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, স্থানীয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস এখনো রয়ে গেছে।
যুবনেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর আবির্ভাব এবং প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া তরুণ ও প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারে একটি নতুন গতি এনেছে। তবে এখনও কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নারীদের সীমিত প্রতিনিধিত্ব এবং চরমপন্থী ও ধর্মীয় কঠোর মতাদর্শী গোষ্ঠীর উত্থান- যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপান্তরের গতিপথ নির্ভর করবে জুলাই জাতীয় সনদের অগ্রগতি কতটা টেকসই হয়, এবং রাজনৈতিক দলগুলো কতটা আন্তরিকভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে অন্তর্ভুক্ত করে- বিশেষত যেগুলো ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে এসেছে, তার ওপর।
নির্বাচনের সামনে করণীয়: বাংলাদেশ যখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন সামনের সময়ে পরিষ্কার হবে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনের প্রতিশ্রুতিগুলো কি প্রকৃতপক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে, নাকি তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা নির্ভর করবে- তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সংস্কার এজেন্ডাকে বাস্তব রূপ দেয়ার ওপর। জুলাই জাতীয় সনদ গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য একটি রূপরেখা প্রদান করেছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন অনেকাংশে নির্ভর করবে পরবর্তী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। অবিচ্ছিন্ন সংলাপ, স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণ- এই তিনটি বিষয় হবে মেরুকরণ কমানো ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আস্থা ফিরিয়ে আনার মূল চাবিকাঠি।
মিশনের পর্যালোচনাঃ এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিস্থিতির ওপর একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রদান করে এবং শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বাস্তবসম্মত সুপারিশ উপস্থাপন করে। আইআরআই মিশনটি বাংলাদেশে মোট ২১টি বৈঠক করে, যেখানে ৫৯ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের সদস্য, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। প্রতিবেদন শেষে আইআরআই তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা সকল ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।