পুলিশ বাহিনীতে জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী এই কমিশন পদোন্নতি, বদলি ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয়ে নজরদারির ক্ষমতা পাবে। এ ছাড়া কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি তিনজন অতিরিক্ত আইজিপি পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্য থেকে একজনকে দুই বছরের মেয়াদে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, খসড়া অধ্যাদেশটি শীঘ্রই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এটি অনুমোদন পেলে সংশ্লিষ্ট অন্য সব আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে। সেই সঙ্গে কমিশনকে পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা, সততা ও কর্মদক্ষতা পর্যবেক্ষণসহ সংস্কারমূলক সুপারিশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, পুলিশের কার্যক্রমে অবৈধ বা অযাচিত প্রভাব প্রয়োগের চেষ্টা করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারবে কমিশন। এ ছাড়া গোপনীয়তা রক্ষা করে সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ তদন্ত করবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
কমিশন একটি স্বায়ত্তশাসিত আইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। এটি নিজস্ব সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও এর ব্যবস্থাপনা করতে পারবে। কমিশনের নিজের নামে মামলা করার অধিকার থাকবে। একই সঙ্গে অন্য কেউ চাইলে কমিশনের বিরুদ্ধেও মামলা করতে পারবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘এ কমিশনের সুফল বা কার্যপদ্ধতি এখনই বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিস্তারিত জানানো হবে।’
সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া ॥ খসড়া অনুযায়ী, কমিশনে মোট সাতজন সদস্য থাকবেন। চেয়ারপার্সন হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। সদস্য সচিব হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি পর্যায়ের কর্মকর্তা।
অন্যান্য সদস্যের মধ্যে থাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, একজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, একজন প্রাক্তন পুলিশ একাডেমি বা পুলিশ স্টাফ কলেজ প্রধান, একজন আইন বা অপরাধবিদ্যার অধ্যাপক এবং ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানবাধিকার কর্মী। সদস্যদের মধ্যে অন্তত দুজন নারী থাকতে হবে।
কমিশনের চেয়ারপার্সন ও সদস্যরা চার বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন, তবে পুনঃনিয়োগযোগ্য হবেন না। যে কেউ দেউলিয়া ঘোষিত, ঋণখেলাপি, বিদেশি নাগরিক, দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত, ফৌজদারি মামলায় দ-প্রাপ্ত বা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে কমিশনের সদস্য হতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি একটি সাত সদস্যের নির্বাচন কমিটির সুপারিশে সদস্যদের নিয়োগ দেবেন। এই নির্বাচন কমিটির প্রধান থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। অন্য সদস্যরা হবেন- জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, সংসদীয় স্বরাষ্ট্রবিষয়ক স্থায়ী কমিটির একজন সরকারদলীয় ও একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং মানবাধিকার বা সুশাসনে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন নাগরিক প্রতিনিধি।
জনবান্ধব পুলিশিং ॥ খসড়ায় বলা হয়েছে, এই কমিশন একটি জনবান্ধব, দক্ষ ও অধিকার রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কাজ করবে, যা রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত থাকবে।
এটি নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির নীতি প্রণয়ন করবে এবং প্রশিক্ষণ, কল্যাণ, কর্মস্থলে নারীবান্ধব পরিবেশ, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে পরামর্শ দেবে।
কমিশন মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে পুলিশি কার্যক্রম তদারক করবে, তদন্ত ও অভিযোজন পদ্ধতি পর্যালোচনা করবে, প্রযুক্তি ও বল প্রয়োগের ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা দেবে এবং জনগণের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করবে যেন পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থা বাড়ে।
এটি প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের সুপারিশ করবে এবং আধুনিক পুলিশিং ও সুশাসন বিষয়ে গবেষণা উৎসাহিত করবে।
অভিযোগ ও অসন্তোষ ॥ অধ্যাদেশে নাগরিক অভিযোগ ও পুলিশ সদস্যদের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ নিষ্পত্তির পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশন সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ তদন্ত করবে, দায় নির্ধারণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবে। অভিযোগকারীর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হবে। এগুলো কমিশন প্রতি তিন মাসে পর্যালোচনা করবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নির্দেশনা দেবে।
সারা দেশে দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় ইউনিট গঠন করা হবে। কমিশন গঠনের তিন মাসের মধ্যে পুলিশকে নিজস্ব অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে অভিযোগ ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।
যদি কোনো অভিযোগকারী এতে অসন্তুষ্ট থাকেন, তিনি ৩০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় পুলিশ জবাবদিহি ইউনিটে আপিল করতে পারবেন। এই ইউনিটে একজন জেলা জজ, একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা এবং ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ থাকবেন। তারা ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন।
কমিশনের তিন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত নাগরিক অভিযোগ নিষ্পত্তি বোর্ড ইউনিটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনবে। এটি তদন্ত শুরু করতে, সাক্ষী তলব করতে এবং ফলাফল প্রকাশ করতে পারবে।
একইভাবে, পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি, বদলি বা শাস্তি সংক্রান্ত অভিযোগ দেখতে একটি পুলিশ অভিযোগ নিষ্পত্তি বোর্ড গঠন করা হবে। কমিশন ও তার অধীন ইউনিটগুলো অভিযোগকারী, সাক্ষী ও তথ্যদাতাদের সুরক্ষার জন্য প্রোটেকশন অর্ডার দিতে পারবে।
কমিশনের নির্দেশ দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। নইলে তা শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে। তথ্যদাতারা (হুইসেলব্লোয়ার) জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১-এর অধীনে সুরক্ষা পাবেন।
নিরীক্ষা ও জবাবদিহি ॥ খসড়ায় বলা হয়েছে, কমিশন অম্বুডসম্যান (নাগরিক অভিযোগের স্বাধীন তদন্তকারী ও তদারকি কর্মকর্তা) এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করবে, যেন কার্যক্ষেত্রে সংঘাত না ঘটে।
কমিশন নিয়মিত বৈঠক করবে, বিশেষজ্ঞ কমিটি ও পরামর্শক নিয়োগ করবে এবং আইন ও অপরাধবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করবে।
প্রতি অর্থবছর শেষে তিন মাসের মধ্যে কমিশন তার কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ও সংস্কার সুপারিশ সম্বলিত বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। প্রতিবেদনটি পরে সংসদে উপস্থাপন করা হবে এবং অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। কমিশনের আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রক ও মহাহিসাব নিরীক্ষক দপ্তর (সিএজি) কর্তৃক নিরীক্ষিত হবে।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১ সদস্যের একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ পুলিশ প্রশাসন গঠন করা। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা বাস্তবায়িত হয়নি।
চলতি বছরের শুরুতে গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনও তাদের প্রতিবেদনে ১১ সদস্যের পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছিল, যার নেতৃত্বে থাকবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি এবং কার্যনির্বাহী সচিব হিসেবে থাকবেন বর্তমান আইজিপি।