Image description

দেশের প্রভাবশালী ও পাঠকনন্দিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর প্রকাশনার ২৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখা একটি বিশেষ নিবন্ধে এর সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকার পত্রিকাটিকে ধ্বংস করার, এর মালিকানা নিয়ে নেওয়ার ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগ নিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার (৪ঠা নভেম্বর) প্রকাশিত লেখায় তিনি এমন অভিযোগ করেন।

মতিউর রহমানের লেখা প্রকাশের পরদিন আজ বুধবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত আরেকজনের লেখা কলামে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রথম আলো বন্ধ করে দেওয়া এবং হাসিনা–ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের কাছে জবরদস্তিমূলকভাবে মালিকানা হস্তান্তরের চেষ্টা করা হয়েছিল।’ তাদের অভিযোগ নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেনের মধ্যে অনলাইনে নানামুখী আলোচনা চলছে। সত্যিই কী আওয়ামী লীগের সরকার পত্রিকাটির সম্পাদক পদে, বা মালিকানায় পরিবর্তন চেয়েছিল? চেয়ে থাকলে সাবেক ‘ক্ষমতাধর সরকার’ তা পারেনি কেন?

নেটিজেনেরা বলছেন, মতিউর রহমানের মতো দায়িত্বশীল সাংবাদিক আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত সরকার সম্পর্কে এমন সময় অভিযোগ করলেন, যখন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নানাভাবে অভিযুক্ত, ক্রান্তিকাল পার করছে, দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং এর শীর্ষ নেতারা বিচারের মুখোমুখি। ফলে দলটির কাছ থেকে এ বিষয়ে বক্তব্য জানার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের সরকারের প্রথম আলোর ‘মালিকানা নিয়ে নেওয়ার ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগ’ কীভাবে ঠেকিয়েছেন, তা নিবন্ধে উল্লেখ করেননি মতিউর রহমান।

সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের ওই দাবির পুরোপুরি সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রকাশনার শুরু থেকে প্রথম আলো আওয়ামী লীগের সরকারের আনুকূল্য ও প্রচারণা পেয়েছে। যা প্রথম আলোর সমসাময়িকে প্রকাশনায় আসা দৈনিক যুগান্তর ও মুক্তকণ্ঠ (প্রকাশনা বন্ধ) পায়নি। প্রথম আলোর নিবন্ধন নেওয়া ও প্রকাশনাও শুরু হয় আওয়ামী লীগের সরকারের আমলেই (১৯৯৬-২০০১)।

আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে পত্রিকাটির সম্পাদক বদল হওয়ার মতো গুঞ্জন এখনো বাজারে আছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে কবি সাজ্জাদ শরিফ পত্রিকাটির সম্পাদক হতে চাচ্ছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা আছে। দেশের জ্যেষ্ঠ অনেক সাংবাদিক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে মুক্ত আলোচনা করছেন। কোনো কোনো লেখায় অবশ্য এ বিষয়ে তথ্যসূত্রের চেয়ে ধারণার প্রকাশ বেশি ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের আমলে রটেছিল, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক পত্রিকাটির সম্পাদক হচ্ছেন, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মতিউর রহমান অবসরে যাচ্ছেন। আনিসুল হক ছিলেন আওয়ামী লীগের সরকারের, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার বিশেষ আস্থাভাজন। তিনি ওই সরকার আমলের বিশেষ সুবিধাভোগী বলেও অভিযোগ আছে। প্রথম আলোর সম্পাদক ও মালিকানা বদলের বিষয়ে আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে গুঞ্জন ছড়ানোর মোটাদাগে তিনটি কারণ খুঁজে পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টেরা।

প্রথমত, কারো ষাট বছর বয়স হয়ে গেলে প্রথম আলোতে আর সাংবাদিকতা, বা চাকরি করা যায় না। তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এমন নিয়ম প্রতিষ্ঠানটিতে চালু আছে। মতিউর রহমানের বয়স ষাট বছর পার হয়েছে। ষাট বছর বয়স হলে বাধ্যতামূলক অবসরের নিয়মটি সম্পাদক মতিউর রহমানেরই চালু করা। দ্বিতীয়ত, প্রথম আলোর মালিকপক্ষের দ্বন্দ্ব ও মামলা-মোকদ্দমা। একপক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে তখন মামলা দায়ের করে। যা প্রথম আলোতেও তখন প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়।

এই দ্বন্দ্বের জের ধরে মালিকপক্ষের একটা অংশ মালিকানায় এস আলম গ্রুপকে ভেড়াতে চায়। এস আলম গ্রুপ আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী হিসেবে ব্যাপক বিতর্কিত। তৃতীয়ত, জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হকের পত্রিকাটির সম্পাদক হতে চাওয়ার আকাঙ্খা। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের সরকার এ দায় নিতে চায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসব প্রসঙ্গে বুধবার দুপুরে  সুখবর ডটকমকে বলেন, শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার চাইলে কোনো একটা ছুতোয় প্রথম আলোর প্রকাশনা বন্ধ করতে, সম্পাদক পদে  দলীয় আস্থাভাজন কাউকে বসাতে পারত। সেটা অন্যায়ভাবে করত। কারণ, কর্তৃত্ববাদী সরকারের জবাবদিহির চিন্তা সাধারণত কম করে। তবে কাণ্ডটা সরকারের জন্য অসম্ভব ছিল না।

তিনি বলেন, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যখন জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেন, প্রায় কাছাকাছি সময়ে কম্বোডিয়ার স্বৈরশাসক হুন সেনের সরকার করসংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করে সে দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। ফলে দ্য কম্বোডিয়া ডেইলি পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায় এবং দ্য নমপেন পোস্ট পত্রিকাটি হুন সেন সরকারের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগীর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় মালিকপক্ষকে।

তথ্য বলছে, প্রথম আলোর প্রকাশনার শুরু হয় আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে ১৯৯৮ সালে। প্রথমে পত্রিকাটি ‘দৈনিক একুশে’ নামে বাজারে আসতে চাইলেও পরে ‘প্রথম আলো’ নামে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নেয়।  ওই সময় একুশে টেলিভিশন বাজারে ‘আসি আসি’ করছিল বলে নামটি পরিবর্তন করেন মতিউর রহমান।

পত্রিকাটি প্রথম বাজারে আসারে খবর আওয়ামী লীগের সরকার বিটিভিতে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ হিসেবে প্রচার করে। এতে পত্রিকাটি সরকারি প্রচারণা পায়। বিটিভির সারাদেশের দর্শকের কাছে পত্রিকাটির বাজারে আসার খবর পৌঁছে যায়। পত্রিকাটিকে শুভকামনা জানিয়ে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীও দেন। যা প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথমদিনের আনুষ্ঠানিক সংস্করণে ছাপা হয়। 

মতিউর রহমান তার নিবন্ধে লেখেন, ‘‘আওয়ামী লীগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু।’ প্রথম আলোকে ধ্বংস করার, এর মালিকানা নিয়ে নেওয়া ও সম্পাদক বদলের কঠিন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। পরিহাস হলো, তিনি আজ দেশছাড়া, আর প্রথম আলো এখনো রয়ে গেছে দেশের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ ও ডিজিটাল গণমাধ্যম হিসেবে।’’

তথ্যমতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ওই মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন। ২০২৩ সালে তার করা ওই মন্তব্যে দেশের অন্যতম প্রধান দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারের বিরাগের বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে উঠে। অবশ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আগেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা পত্রিকাটি সম্পর্কে এই মনোভাব প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে ৫২টি মামলা দায়ের হয় পত্রিকাটির বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বিষোদগার সম্পর্কে তখন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘পত্রিকার কি দায়িত্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা ঠিক করে দেওয়া? দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে যেতে হবে, এটা কি কোন পত্রিকা বা সম্পাদক লিখতে পারেন। এটা যখন লেখা হয়, তখন থেকেই তো তার দুরভিসন্ধি, তার মনোভাব বোঝা যায়। এরপর তার সম্পর্ক ভালো কীভাবে আশা করা যায়?’

আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ ছিল, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তাতে প্রথম আলোসহ কয়েকটি দৈনিকের ভূমিকা রয়েছে। শেখ হাসিনাও সংসদে সেই কথা বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা আদাজল খেয়ে নেমে গেল।’

২০০৭ সালের ১১ই জুন প্রথম আলো পত্রিকায় ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান। সেই ক্ষোভ এখনো রয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে।

তবে অভিজ্ঞদের মতে, দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা সব সময়েই চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। সংবাদমাধ্যমের ওপর একদিকে মালিকগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার চাপ, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু। বিগত সরকারের আমলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার-নির্যাতন করা হয়েছে, অন্যদিকে বহু গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুবিধাভোগী সম্পর্ক গড়ে তুলে সরকারদলীয় মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন।

প্রথম আলো সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকারের মুখপত্র হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরুর পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০০টির বেশি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের। এমনকী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মামলা রুজু হয়েছে একটি।