ড. আলী রীয়াজ ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি। ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ‘জুলাই সনদ’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে এই সনদ প্রণীত হয়। এর পেছনের দর্শন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে দৈনিক কালবেলার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ
জুলাই সনদকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? এর পেছনের দর্শনটা কী?
ড. আলী রীয়াজ: জুলাই সনদকে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চেষ্টার ফসল হিসেবে দেখতে হবে। এই প্রচেষ্টা শুধু জাতীয় সনদের মধ্য দিয়ে হচ্ছে, তা নয়। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো এবং তার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ এবং প্রত্যাশা পোষণ করে আসছে। জুলাই সনদ সেই সম্মিলিত প্রত্যাশাকেই ধারণ করার চেষ্টা। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রক্ষমতাকে যেভাবে ব্যক্তিকরণ করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে একটি পুনর্গঠন অপরিহার্য ছিল। সেই বিবেচনা থেকেই দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সনদটি তৈরি হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, যে কোনো রাজনৈতিক দলিলই একটি সূচনা। এটি রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার চলমান অংশ, যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তা আজও অব্যাহত আছে।
এই সনদে দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য ও আপস হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত ও টেকসই?
ড. আলী রীয়াজ: অঙ্গীকারের দিক থেকে এটিকে আমি বাস্তবসম্মত বলেই মনে করি। অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পেরেছে যে, এই মুহূর্তে হয়তো সবকিছু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, কিন্তু তারা বিষয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় বা অকিঞ্চিৎকর বলে উড়িয়ে দেয়নি। এখানেই প্রতিশ্রুতির জায়গাটা স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, এর প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ। চেষ্টা করেছি যাতে সবাই জানতে পারে—কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কার অবস্থান কী এবং কোথায় ভিন্নমত রয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে জবাবদিহির সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমার প্রত্যাশা, জনপ্রতিনিধিরা যখন যে কাঠামোতেই আসুন না কেন, এই সনদের দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন। কারণ, আরও অনেক কাজ বাকি এবং এগুলো সম্পন্ন না করে সামনে এগোনো কঠিন। এই সনদের বাস্তবায়ন শুধু আশা নয়, এটি এখন নাগরিক, গণমাধ্যম এবং সব রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত দায়িত্ব।
ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক কতটুকু? স্বপ্ন কতটা পূরণ হয়েছে?
ড. আলী রীয়াজ: আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন অনেক বড় স্বপ্নই দেখি। হ্যাঁ, অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। সবটা আমরা পারিনি, কিন্তু চেষ্টার কমতি ছিল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই দলিলটি মানুষের সামনে একটি রূপরেখা হিসেবে থাকল। সবটা হয়তো এখন অর্জিত হয়নি, কিন্তু এটি মানুষকে এই তাগিদ দেবে যে—‘হ্যাঁ, এটা আমাদের করতে হবে।’ এইটুকু যে অর্জিত হয়েছে, সেটাই বড় ব্যাপার। এর গুরুত্ব শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, বরং আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকেও। আমরা প্রমাণ করেছি যে, সবাই মিলে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
কালবেলা: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? তাদের মধ্যে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন দেখেছেন কি?
ড. আলী রীয়াজ: আমার অভিজ্ঞতা খুবই ইতিবাচক। আমি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই:
প্রথমত, আমি দেখেছি প্রত্যেকেই রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিবর্তন আনার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থার যে অনেক ত্রুটি রয়েছে, তা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তাদের দিক থেকে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে গিয়ে অনেক দল সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেনি। এটা ছিল তাদের পক্ষ থেকে এক ধরনের স্যাক্রিফাইস।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ইতিহাসে এতগুলো রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বসে রাষ্ট্র সংস্কারের মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করেছে, যা অভূতপূর্ব। প্রত্যেকের ভিন্ন অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তারা পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এই সংস্কৃতিটাই আশা জাগানিয়া।
চতুর্থত, এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ রাখতে গণমাধ্যমের নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমের অনেক অপূর্ণতা থাকতে পারে, কিন্তু তারা যদি এই দায়িত্বশীল ভূমিকা আগামীতেও পালন করে, তবে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
কালবেলা: অনেকে অভিযোগ করছেন, সনদে সব নিবন্ধিত দল সই করেনি এবং অনেককে বাইরে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
ড. আলী রীয়াজ: আমার প্রথম আপত্তি ‘নিবন্ধিত দল’ শব্দটিতে। ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আওয়ামী লীগ তো একসময় নিবন্ধিতই ছিল। আবার ২৪-এর নির্বাচনের আগে রাতারাতি তৈরি হওয়া অনেক দলও নিবন্ধিত। তাহলে নিবন্ধনের মাপকাঠি কী? অন্যদিকে, এই আন্দোলনের মূল শক্তি যারা ছিলেন, যেমন এনসিপি, তারা তো তখন গঠিতই হয়নি। জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত ছিল না। তার মানে কি তাদের বাদ দিয়ে আলোচনা করতে হবে? সুতরাং, ‘নিবন্ধিত দল’র যুক্তিটি আমি সঠিক মনে করি না।
এটা ঠিক যে, প্রক্রিয়াটিকে আরও বিস্তৃত করা যেত। কিন্তু সময়ের একটি সীমাবদ্ধতা ছিল। আমরা অত্যন্ত স্বল্প সময়ে অনেকটা পথ এগিয়েছি, যা রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের সম্মিলিত কৃতিত্ব। আর কাউকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা-ও পুরোপুরি ঠিক নয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে ১ লাখের বেশি মানুষের মতামত এসেছে, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও পেশাজীবীদের অবদান ছিল।
কালবেলা: এনসিপিসহ কয়েকটি বাম দলের সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ড. আলী রীয়াজ: এনসিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছে এবং তারা কিছু প্রস্তাবও দিয়েছে। আমরা সেগুলো বিবেচনায় নিচ্ছি এবং তাদের সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত আছে। অন্য বাম দলগুলোর কিছু বক্তব্যও আমরা সনদে অন্তর্ভুক্ত করেছি, যেমন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিষয়টি। আলোচনার দরজা সবসময় খোলা। গণফোরাম প্রথমে স্বাক্ষর না করলেও পরে বিবেচনা করে করেছে। আমি আশা করি, অন্য দলগুলোও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে।
কালবেলা: এই উদ্যোগ কি বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবে, নাকি এটি পুরোনো শক্তির পুনর্বিন্যাস মাত্র?
ড. আলী রীয়াজ: আমি আশা করি, এটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবে। তবে এই সংস্কৃতি শুধু আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা প্রয়োজন। তাদের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, আমাদের জনসমাজের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। জবাবদিহি কেবল নির্বাচনের সময় নয়, এটি সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় নাগরিকদেরও যুক্ত হতে হবে। আমাদের আচরণ, আলোচনা এবং সমালোচনার মাধ্যমে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
কালবেলা: দলগুলো কি এখন নীতিনির্ভর রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে, নাকি দলীয় স্বার্থই এখন প্রধান চালিকাশক্তি?
ড. আলী রীয়াজ: আমি ‘দলীয় স্বার্থ’ না বলে ‘দলীয় অবস্থান’ বলতে চাই। দলগুলো অবশ্যই তাদের অবস্থানে থাকবে; কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একটি বৃহত্তর ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে শুধু সনদের বিবেচনা থেকে নয়, আজ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি জাতীয় ঐক্য। আমাদের মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে; কিন্তু কিছু সাধারণ লক্ষ্যে সবাইকে এক হতে হবে। গণতন্ত্র, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা, এবং একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রশ্নে আমাদের সবাইকে এক সুরে কথা বলতে হবে। আমাদের এখানে অনেক স্রোত থাকবে; কিন্তু মোহনা হবে একটি। সেই মোহনাতেই আমাদের মিলিত হতে হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার কি কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি এর জন্য ব্যাপক সামাজিক পুনর্গঠন প্রয়োজন?
ড. আলী রীয়াজ: শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থা দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব নয়। এর জন্য অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, দলের আর্থিক স্বচ্ছতা, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সামাজিক সচেতনতা—এ সবই অপরিহার্য। অর্থাৎ, এটি একটি সামগ্রিক পরিবর্তনের বিষয়। এই পরিবর্তন রাতারাতি আসবে না, তবে আমাদের হাতে ইউরোপের দেশগুলোর মতো অফুরন্ত সময়ও নেই। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতির বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে এবং এই কাজটি করতে হবে সবাই মিলে।
কালবেলা: এই গণতান্ত্রিক রূপান্তর কি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে?
ড. আলী রীয়াজ: এ মুহূর্তে হয়তো করবে না, কারণ আমরা এখন একটি উত্তরণকালের (ট্রানজিশন) মধ্যে আছি; কিন্তু যদি আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করতে পারি, যেখানে সুযোগের সমতা থাকবে এবং দুর্নীতির পরিবর্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমরা অবশ্যই একটি মডেল হয়ে উঠব। আমরা যদি সাংবিধানিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো সফলভাবে করতে পারি, তখন অন্য দেশগুলো দেখবে যে এটি সম্ভব এবং টেকসই।
কালবেলা: অনেকে বলছেন, এই প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। আপনি কি একমত?
ড. আলী রীয়াজ: আমি ‘টেস্ট কেস’ শব্দটি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন, কারণ অতীতে এই শব্দটি বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এখনকার বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনো দেশই একক মডেল নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে শেখে। আমরা যেমন অন্য দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার ভুল থেকে শিখছি, তেমনি আমাদের সাফল্য থেকেও অন্যরা শিখবে। তাই আমি একে ‘টেস্ট কেস’ না বলে একটি শিক্ষণীয় প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে চাই।
কালবেলা: এই ঐকমত্য প্রক্রিয়া যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?
ড. আলী রীয়াজ: ঐকমত্যের জায়গাটি এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের জন্য কোন বিষয়গুলো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে দলগুলো একমত হয়েছে। সুতরাং, মূল ঐকমত্য ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা কম। মূল চ্যালেঞ্জটি হলো এর বাস্তবায়নে। সেখানে ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো বিকল্প নেই। তাদের সমালোচনা থাকবে, ত্রুটি থাকবে; কিন্তু দিন শেষে দেশ তাদেরই পরিচালনা করতে হবে। তাদের ওপর অনাস্থা প্রকাশ না করে, তাদের সক্ষমতা ও অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এই যে ৫৩ বছরের ইতিহাসে আমাদের এত অর্জন, এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় অবদান রয়েছে।
কালবেলা: ব্যক্তিগতভাবে এ উদ্যোগকে আপনি ইতিহাসের কোন জায়গায় স্থাপন করবেন?
ড. আলী রীয়াজ: এর বিচার ইতিহাসই করবে। আমরা যখন কোনো ঘটনার মধ্যে থাকি, তখন তাকে একভাবে দেখি; দূর থেকে হয়তো ভিন্নভাবে দেখা যাবে। তবে আমরা একটি ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছি। ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত নয়; ভবিষ্যৎ আসলে আমরাই নির্মাণ করি। আমাদের নেতৃত্ব, নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে যে ভবিষ্যৎ তৈরি করবে, সেটাই বলে দেবে এই মুহূর্তটির গুরুত্ব কতটা ছিল।
কালবেলা: অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার আগে জরুরি ছিল। আপনারা কাঠামোগত সংস্কারে জোর দিলেন কেন?
আলী রীয়াজ: দুটি বিষয়ই পরস্পরের পরিপূরক। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে জোর দিয়েছি কারণ শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংস্কারের জন্য এক ধরনের ইতিবাচক চাপ তৈরি করবে। যখন প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে, তখন দলগুলোও নিজেদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো পরিবর্তনে বাধ্য হবে। এটি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, যেখানে একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করবে।
কালবেলা: বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে সংকট ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের পথ কী?
আলী রীয়াজ: আমি উত্তরণ নিয়ে আশাবাদী। তবে এর জন্য সরকারকে দৃঢ়তা দেখাতে হবে। সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়; কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। যদি এই উত্তরণ সফল না হয়, তবে দুটি বড় বিপদ হতে পারে। এক. আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। দুই. আমরা আবারও স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদের বৃত্তচক্রে আটকা পড়তে পারি। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
কালবেলা: এই আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা ছিল অভূতপূর্ব, যাদের একসময় রাজনীতি-বিমুখ ভাবা হতো। এই নবজাগরণকে কীভাবে দেখছেন এবং রাষ্ট্র গঠনে তাদের শক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে?
আলী রীয়াজ: আমি কখনোই মনে করিনি তরুণরা রাজনীতিবিমুখ। আমি বরাবরই বলেছি, তারা যে ধারার রাজনীতির কথা বলছে, সেটা হয়তো আমরা বুঝতে পারছি না। তাদের রাজনীতির ভাষা ভিন্ন। কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো প্রমাণ করে, তারা দলের বাইরে থেকেও সমাজের মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে।
এই শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যেহেতু তরুণদের, তাই তাদের আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে হবে এবং নীতি নির্ধারণে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন, বাজেট প্রণয়নের আগে সারা দেশের তরুণদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। তাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, তারা কেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা চায়। এভাবেই তাদের রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির পুনর্গঠন হচ্ছে। এটি কি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে?
আলী রীয়াজ: এর সাফল্য নির্ভর করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তির সদিচ্ছার ওপর। তারা যদি ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিজেদের ‘পেটোয়া বাহিনী’ হিসেবে ব্যবহার না করে একটি নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে, তবেই ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার আছে; কিন্তু সেই পরিবেশটি তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থেকে প্রত্যেক ছাত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে ছাত্র রাজনীতি তার সুস্থ ধারায় ফিরবে।
কালবেলা: তরুণ প্রজন্মের প্রতি আপনার নির্দিষ্ট কোনো পরামর্শ থাকবে কি?
আলী রীয়াজ: আমি তিনটি পরামর্শ দিতে চাই:
প্রথমত, প্রশ্ন করতে শিখুন। গণমাধ্যম, সরকার বা রাজনীতিবিদ—আপনাকে যে যা-ই বলুক, প্রশ্ন করুন, ‘এটা কেন?’ জানার আগ্রহ এবং প্রশ্ন করার ক্ষমতাই পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
দ্বিতীয়ত, আপনি কেমন ভবিষ্যৎ দেখতে চান, তা স্পষ্ট করে বলুন। আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন হবে, সেই রূপরেখা তুলে ধরুন। কারণ দেশ ভালো না থাকলে আপনি ভালো থাকবেন না।
তৃতীয়ত, সক্রিয় থাকুন। এর অর্থ এই নয় যে, আপনাকে কোনো দলে যোগ দিতে হবে। সামাজিক সংগঠনে, ডিবেট ফোরামে বা যে কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত থাকুন। ব্যক্তির সক্রিয়তাই সম্মিলিত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।