আলোচনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ‘জেনেভা ক্যাম্প’। মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্যাম্পের ভেতর ঘটছে একের পর এক সংঘর্ষ, খুন। যৌথ বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানেও দমানো যাচ্ছে না সন্ত্রাসীদের। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরো মোহাম্মদপুরে। ঢাকা উত্তর সিটির মোহাম্মদপুর থানার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত এই জেনেভা ক্যাম্প মূলত মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের আবাসস্থল। ১৯৭১ সালে বাস্তুহারা বিহারিরা যারা মোহাম্মদপুরের রাস্তা, মসজিদ, স্কুলে অবস্থানরত ছিল তাদের জন্য ’৭২ সালে লিয়াকত হাউজিং সোসাইটির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর কলেজগেটের অদূরে গজনবী রোড ও বাবর রোডের মাঝের ১৭ একর জায়গা নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। সেখানেই বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছেন এই উর্দুভাষিরা। বর্তমানে নয়টি ব্লকে ভাগ হওয়া এই ক্যাম্পে প্রায় ৩৫ হাজার বিহারির বসবাস। ছোট্ট ছোট্ট খুপরি ঘরে ১৫-২০ জন করে থাকেন। দিনে-রাতে পালা করে ঘুমাতে হয় তাদের। মূলত রাজধানীর বিভিন্ন সেলুনে নরসুন্দরের কাজই তাদের প্রধান পেশা। তবে এই সরু গলির ঘরগুলোকে অনেকেই আবার মাদকের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। বছরের পর বছর হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের কারবার চলছে এই ক্যাম্পে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকে মরিয়া হয়ে উঠে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজা, বোবা বিরানি, শাহ আলম, তারিক, পারমনু ওরফে গাল কাটা মনু, চেম্বার রাজ, ঠোঁট গোলাবি, ফারুক, ইমতিয়াজ, আরমান, পলু কসাই, সৈয়দপুরিয়া, ছটু মাসুদ, চারকুসহ একাধিক গ্রুপ। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেল। তার হয়ে কাজ করেন তার ভাই টুনটুন, রানা, রাজন, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী, বানর আরিফ আরও অনেকে। আর চুয়া সেলিমের পক্ষে আছে পিচ্চি রাজা, আরমান, আকরাম, মোল্লা আরশাদ, পেলু, কোপ মনু, পিস্তল নাঈম, শাহজাদা গেইল হীরা, সালাম, শান্ত, ফাট্টা আবিদ। এদিকে সৈয়দপুরিয়া গ্রুপে আছে তিল্লি শাহিদ, কামাল বিরিয়ানি, ইরফান বিরিয়ানি, মোল্লা জাহিদ, সাজ্জাদ, আমজাদ আলী বাবু। এদের মধ্যে বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, সৈয়দপুরিয়া গ্রুপের বাবু ওরফে আমজাদ আলী বাবু, আসলাম ওরফে মেন্টাল আসলাম ও শেখ গোলাম জিলানি মূলত পারিবারিকভাবে ইয়াবা ও হেরোইনের কারবারে জড়িত। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ছিল বুনিয়া সোহেলের। আর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিরোধীদের সাপোর্টে রাজত্ব করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন চুয়া সেলিম চক্র। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চুয়া সেলিমের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, অস্ত্র লুটসহ ৩৫টি মামলা রয়েছে। অপরদিকে বুনিয়া সোহেলের বিরুদ্ধেও একাধিক হত্যা ও মাদক মামলা রয়েছে। তবে আগে এসব দ্বন্দ্বে লাঠি, চাকু, দা, বঁটি, ছুরি ব্যবহার হলেও এখন যোগ হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রাণঘাতী কাস্টোমাইজড ককটেল।
বুধবার রাত ৩টার দিকে মাদক ব্যবসা নিয়ে ক্যাম্পের ৪ নম্বর গলিতে এমনই এক সংঘর্ষে জড়ায় বুনিয়া সোহেল গ্রুপ ও চুয়া সেলিম-পিচ্চি রাজা গ্রুপ। এসময় গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণে মো. জাহিদ (২০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। জাহিদ জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা মৃত মো. ইমরানের সন্তান। কিন্তু গত ২০শে অক্টোবর রাতেও জেনেভা ক্যাম্পে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে ৩২টি তাজা ককটেলসহ বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম, দেশীয় অস্ত্রসহ ৪ জনকে আটক করে। পরদিন থেকে আবারো উত্তাল হয়ে ওঠে বিহারি ক্যাম্প। এরপরেই বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এরপরই মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পে সেনাবাহিনী ও র্যাব যৌথ অভিযান চালায়। ওই অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকসহ চারজনকে আটক করা হয়। এর আগেও গত ২৮শে সেপ্টেম্বর রাত ৮টা থেকে রাত ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩০০ গ্রাম হেরোইন, ২৫০ গ্রাম গাঁজা, ১টি চাপাতি, ২টি তলোয়ার, ১০টি গুলতি, ২ হাজার পিস মার্বেল, ২০টি হেলমেট, ১২টি লাইফ জ্যাকেট, ৫টি লোহার রডসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২২শে সেপ্টেম্বরও ১২০ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ৮টি ককটেল, ২টি পেট্রোল বোমা, ৬টি সামুরাই, ৫টি হেলমেট, ৩টি ছুরি, ১১টি চোরাই মোবাইল ফোন এবং ৫০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। এমন একের পর এক অভিযান চলছেই।
গত ১১ই আগস্ট মাদক বিক্রি নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পের পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপের দ্বন্দ্বে ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় শাহ আলম (২০) নামের এক তরুণ নিহত হন। এর আগের দিনও ওই দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণে এক নারীও আহত হয়েছেন। এর আগে ক্যাম্পের ৮ নম্বর সেক্টর হয়ে যাওয়ার সময় চুয়া সেলিম ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাজ্জেন ওরফে রহমত নামে ১৩ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তার আগে ১৬ই অক্টোবর মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হন ক্যাম্পের ৮ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ কাল্লু (৩৮)। গত ১লা মে বিকালে মাহতাব হোসেন (৩২) নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে বুনিয়া সোহেলের আস্তানায় তুলে নিয়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ছাড়াও একইভাবে গত বছরের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ক্যাম্পের বাবুল হোসেনের ছেলে অটোরিকশাচালক সানু। মাদক ব্যবসা নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন সনু। এসময় বেল্লাল, শাহ আলম, শুভ, জানে আলম, শাওন নামে আরও বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। একইদিনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শাহেন শাহ নামের আরও একজন। মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বে ক্যাম্পের মো. ইসমাইল হোসেনের ছেলে মো. সাগর নামে আরও একজন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানেও শান্ত হচ্ছে না জেনেভা ক্যাম্প। মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই চলছে বিভিন্ন গ্রুপের দৌরাত্ম্য। তারা বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের সবচেয়ে বেশি মাদক কারবার চলে ক্যাম্পের ৭ নম্বর ও ৪ নম্বর গলিতে। এর সঙ্গে চোয়া সেলিম, শাহ আলম, তারিক, পারমনু ওরফে গাল কাটা মনু, চেম্বার রাজ, পিচ্চি রাজা, ঠোঁট গোলাবি, ফারুক এবং ইমতিয়াজসহ বেশ কয়েকজন জড়িত। এদের কাছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র রয়েছে। এ ছাড়াও সরকার পতনের আগে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দেয়া অবৈধ অস্ত্রেরও বিশাল মজুত রয়েছে তাদের কাছে। এরা কেউ ক্যাম্পে থাকে না। ক্যাম্পের বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে সোর্সের মাধ্যমে তারা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করে। এদের অস্ত্র ও মাদকও ক্যাম্পের বাইরে থাকে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালেও তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’র তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের অপরাধ ও মাদকের বিস্তার রোধে আমরা নিয়মিতভাবে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আসছি। অভিযানে আমরা মাদক কারবারি, মাদক বিক্রেতা, অস্ত্রের জোগানদাতা, ককটেল সংরক্ষণকারীসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করি। বিশেষ করে গত বছরের ৩১শে অক্টোবর সিলেটে অভিযান চালিয়ে বুনিয়া সোহেলকে এবং এ বছরের ৮ই জানুয়ারি ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতাল থেকে চুয়া সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর কিছুদিন পরেই তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবারো অপকর্মে জড়ায়। এরা অনেক আধুনিক। তারা ওয়াইফাই ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। মোবাইল ফোনে সিম থাকে না। আবার ক্যাম্প ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় কোথায় মাদক ও অস্ত্র রেখে দেয় তাও পাওয়া যায় না। আর তাদের লোক ক্যাম্পের চারপাশে ছড়ানো থাকে। আমরা ঢোকার আগেই তারা খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। তাই আমরাও এখন আমাদের অভিযানের ধরন পাল্টাচ্ছি। যত চালাকই হোক না কেন তাদের সকলকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
বিষয়টি নিয়ে ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) নজরুল ইসলাম, মাদক বিক্রেতার চেয়ে মূল নিয়ন্ত্রককে ধরা না গেলে ক্যাম্পের পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত করা সম্ভব নয়। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গডফাদারদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।