
রাজধানীর সড়কে রিকশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ‘দেখনদারি’ পদক্ষেপ নিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয় ব্যয়বহুল ‘রিকশা ট্র্যাপার’। এটির মাধ্যমে রিকশাকে মূল সড়কে ওঠা থেকে আটকানোর কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। রিকশা দিব্যি পার হয়ে যাচ্ছে, আর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গাড়ি ও মোটরসাইকেল চালকরা।
শুধু তা-ই নয়, এই ট্র্যাপারই এখন যানজট, দুর্ঘটনা ও ক্ষতির নতুন উৎসে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো— মাঠ পর্যায়ের এই বাস্তবচিত্র সম্পর্কে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কার্যত অন্ধকারে। পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে তদারকিতে চরম অবহেলার।
ট্র্যাপার দিয়ে চলাচলকারী ভুক্তভোগী অন্যান্য যানবাহনের চালকরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ ট্র্যাপার লাগিয়ে ভুলে গেছেন। তারা এসে পরীক্ষা করে দেখেন না এগুলো কাজ দেয় কি না! এসব ট্র্যাপার রিকশা আটকানোর জন্য কোনো কাজ তো দেয়ই না, উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত করছে অন্য যানবাহন। মাঠ পর্যায়ের এসব তথ্য না থাকার কারণেই ট্রাফিক পুলিশ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ব্যাটারিচালিত ও প্যাডেল-চালিত রিকশা অনায়াসেই ট্র্যাপার পার হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল আটকে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গাড়ির টায়ার ফেটে যাচ্ছে, চেসিস আটকে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এসব বিপদ থেকে বাঁচতে যানবাহন ধীরগতিতে পার হওয়ার সময় তৈরি হচ্ছে লম্বা যানজট
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিকশাকে আইনের আওতায় না এনে এবং সংখ্যা না কমিয়ে এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব না। এখন এটি হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্বাভাবিক যানবাহনের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়েছে ট্র্যাপারগুলো। অনেক স্থানে ট্র্যাপারের কাঁটা নষ্ট হয়ে কিংবা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাড়ির টায়ার, চেসিস আটকে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে যেসব এলাকায় ট্র্যাপার বসানো হয়েছে তার অন্যতম হলো গুলশান ও রমনা এলাকা। গুলশানে আটটি ও রমনাতে রয়েছে সাতটি ট্র্যাপার। এই দুই এলাকায় সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত ও প্যাডেল-চালিত রিকশা অনায়াসেই ট্র্যাপার পার হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল আটকে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গাড়ির টায়ার ফেটে যাচ্ছে, চেসিস আটকে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এসব বিপদ থেকে বাঁচতে যানবাহন ধীরগতিতে পার হওয়ার সময় তৈরি হচ্ছে লম্বা যানজট, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোগান্তিতে ফেলছে সাধারণ মানুষকে।
স্থানীয় চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, যে রিকশা আটকানোর জন্য ট্র্যাপার বসানো হয়েছিল, সেই রিকশাই এখন দিব্যি চলছে। এছাড়া, অল্প বৃষ্টিতেই ট্র্যাপারের ফাঁকে কাদা জমে নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। অ্যাঙ্গেল বা কাঁটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় আহত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।

রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে ব্যাটারি গলিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রিকশা আটকানোর জন্য বসানো বিশেষ ট্র্যাপার এখন কার্যত অকেজো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ফাঁকে জমে গেছে মাটি, সুরকি আর খোয়া। ফলে যে যন্ত্রটি রিকশা প্রবেশ ঠেকানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, সেটিই এখন রিকশা চলাচলের স্বাভাবিক পথ হয়ে গেছে। নিয়মিত পরিচর্যা বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ট্র্যাপারটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে পুরোপুরি।
এই এলাকা দিয়ে চলাচলকারী রিকশাচালক মঞ্জু মিয়া বলেন, ‘আমগো এভাবে আটকানো যাবে না। আমরা কোনো না কোনো পদ্ধতি বের করে পার হয়ে যাচ্ছি। এগুলো অযথা দিয়েছে সরকার, উল্টো টাকা নষ্ট হয়েছে।’
ওই ট্র্যাপার দিয়ে গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) পার হন প্রাইভেটকারের চালক হাফিজুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেখেন এখন কী অবস্থা, কাদামাটিতে ট্র্যাপার রাস্তার সমান, দেখার যেন কেউ নাই। রিকশা কিন্তু ঠিকই চলে যাচ্ছে, আমাদের যেতে হচ্ছে আস্তে ধীরে। ফলে পেছনে গাড়ি আটকে যাচ্ছে। আর কাদামাটি যখন থাকে না প্রায় সময় ট্র্যাপারের কাঁটা লেগে যাচ্ছে গাড়ির চেসিসে। গাড়ির মালিকের বাসা সেগুনবাগিচায়। প্রায় প্রতিদিন এই ট্র্যাপারের ওপর দিয়ে পার হতে হয়। এখন পর্যন্ত তিনবার ট্র্যাপার চেসিসে লেগেছে। অনেক মূল্যবান পার্টস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
ডিএমপির ট্রাফিক রমনা বিভাগের ট্র্যাপারগুলোরও একই অবস্থা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মেহেদি হাসান শাকিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ফিডব্যাক মোটামুটি পাওয়া যাচ্ছে। অনেক রিকশাচালক ভয়ে আসে না, আবার অনেকে পার হয়ে যায়। তবে, একটি বিষয় জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে যে এই পথে রিকশা যাবে না।’
অন্যান্য যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ট্রাফিক বিভাগের নজরে আসছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের তো কেউ অভিযোগ কিংবা জানায়নি। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। সিনিয়র স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

গুলশান ট্রাফিক বিভাগের কালাচাঁদপুর এলাকায় গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, রিকশাচালকরা একটু বাঁক নিয়ে সহজে ট্র্যাপার পার হয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় অল্পস্বল্প আটকে গেলেও চাকা তুলে নিয়ে পার হচ্ছেন। অথচ, ট্র্যাপারের কাঁটাগুলো বেশ উঁচু হওয়ায় প্রাইভেটকার চলাচল করতে প্রায় সময় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চেসিসের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে কাঁটা। মোটরসাইকেলের চালকদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। ট্র্যাপারের ট্র্যাপ থেকে বাঁচতে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারগুলোকে ধীরগতিতে চলাচল করতে হচ্ছে। ফলে সড়কে যানজট তৈরি হচ্ছে। একটি রিকশা বা অন্য কোনো বাহন ট্র্যাপারে আটকে গেলে সেখানে ২০ থেকে ২৫ মিনিটের যানজট তৈরি হচ্ছে। গলি থেকে মূল সড়কেও যা ছড়িয়ে পড়ছে।
গত বৃহস্পতিবার এই ট্র্যাপার পার হতে গিয়ে আব্দুর রব নামের এক মোটরসাইকেলচালক পড়ে যান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘রিকশার তো বিন্দুমাত্র ক্ষতি নাই, ট্র্যাপারের ট্র্যাপে আছি আমরা। ট্র্যাপারের কাঁটার জন্য গাড়ি নিয়ে অনেক সময় পড়ে যেতে হয়। অন্যদিকে, পুলিশ এটি লাগিয়ে কোনো খোঁজ খবর নেয় না আসলে কাজ করছে কি না। তারা শুধু বলে, ভালো কাজ দেয়। এটা কি ভালো কাজ দেওয়ার নমুনা?’
তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন ওই রাস্তা দিয়ে পার হওয়া প্রাইভেটকারচালক মো. রবিউল। বলেন, ‘এটা দিয়ে তো কোনো লাভ হয়নি। উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া, গাড়ির চেসিসে লেগে যাচ্ছে। ট্র্যাপারের ফলে যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে, গচ্চা দিতে হচ্ছে আমাদের।’
তবে, ভুক্তভোগীদের এমন অভিমত নাকচ করে দিয়ে ডিএমপি ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ট্র্যাপার ভালো কাজ দিচ্ছে। এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. জিয়াউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে কালাচাঁদপুরসহ ট্রাফিক গুলশান বিভাগের অধীনে আটটি ট্র্যাপার রয়েছে। ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) কিছুটা পড়েছে। রিকশাচালকদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে যে ওই দিকে ট্র্যাপার আছে, যাওয়া যাবে না। তারপরও কিছু রিকশা পার হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ট্র্যাপারে আটকেও যাচ্ছে। মূলত এটার ইমপ্যাক্টটা পজিটিভ।’

কিছু কিছু ট্র্যাপারে অ্যাঙ্গেলের ফাঁক বড় হয়ে যাচ্ছে, এতে আটকে যাচ্ছে মোটরসাইকেলের চাকা। আবার অনেক সময় প্রাইভেটকারের চেসিস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্র্যাপারের কাঁটায়। বিষয়গুলো নজরে আসছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমে কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছিল। পরে আমরা ডিজাইন পরিবর্তন করে দিয়েছি। অতিরিক্ত চাপের কারণে অ্যাঙ্গেলগুলো বেশি ফাঁকা হয়ে যেত, কাঁটাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এ কারণে পরে আমরা ডিজাইন চেঞ্জ করি। অনেকগুলো রিপেয়ারও (মেরামত) করে দিয়েছি।’
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, গত মার্চ মাসে পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর তিনটি স্থানে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসানো হয়। তখন কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশের ব্যাটারি গলি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ নম্বর গেটের সামনে এবং পুরাতন রমনা থানার সামনের সড়কে এটি বসানো হয়। পরে আরও কয়েকটি এলাকায় এটি বসাতে দেখা যায়। ধীরে ধীরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বসানো হয় এই ট্র্যাপার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। প্যাডেল রিকশাসহ এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। ঢাকায় গত কয়েক বছরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। আগে বেশিরভাগ রিকশাই অলিগলিতে চলত। তবে, গত বছরের শেষের দিক থেকে এসব রিকশা মূল সড়কে উঠে এসেছে। ফলে রাজধানীর সড়কে ‘রিকশার বিস্ফোরণ’ হয়েছে— এমন মন্তব্যও করেছেন কেউ কেউ। এসব রিকশার কারণে একদিকে যানজট তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত যানবাহন ও গণপরিবহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বরাবরের মতো বলছেন, রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে এবং চালকদের আইনের আওতায় না এনে শুধু মূল সড়কে যেন উঠতে না পারে সেজন্য ট্র্যাপার বসানো কোনো বিজ্ঞানসম্মত কাজ নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন সিস্টেম নেই। সবার আগে রিকশার জন্ম ঠেকাতে এবং যারা সড়কে নেমেছেন তাদেরকে শৃঙ্খলার (ডিসিপ্লিন) আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এহসান বলেন, ‘সর্বপ্রথম রিকশার জন্মানো ঠেকাতে হবে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেই নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। শুধু ট্র্যাপার দিয়ে হবে না, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই ট্র্যাপারের কারণে অন্য যানবাহনের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এটি দিয়ে অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’