Image description
 

মানিকগঞ্জের ঘিওরে বহুল আলোচিত ‘ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’। নাম শুনলেই বোঝা যায়, প্রকৃতির কোলে শান্তির ঠিকানা; কিন্তু আড়ালের কাহিনী যেন একেবারে উল্টো চিত্র ডেরাকে ঘিরে! বিলাসবহুল এই রিসোর্ট ঘিরে অভিযোগের পাহাড়।

 

কৃষিজমি দখল, কবরস্থান ভরাট, পরিবেশ ধ্বংস, আর রাতের আঁধারে অসামাজিক কর্মকাণ্ড— সবকিছু মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।

 

দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বহুল আলোচিত ‘ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’র  অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে নিউজের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিল করেছে। সেই সঙ্গে ডেরা রিসোর্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহকারী নিয়ন্ত্রক (সিনিয়র সহকারী সচিব) শেখ রাশেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনা পত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য জেলা প্রশাসক, মানিকগঞ্জকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত শাখার ৩ মার্চ তারিখে ৭  সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

 

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নাজমুল হাসান খানকে। অন্যরা হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিবালয় সার্কেল) সাদিয়া সাবরিনা চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান,পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন, কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হোসেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আহসান কবির বুলবুল ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মিয়া।

 

বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি অভিযোগকারীদের বক্তব্য এবং রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের জবাব বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

 

প্রতিবেদনে উঠে আসা প্রধান অভিযোগগুলো হলো- কৃষিজমি দখল ও ক্ষতিপূরণ না দেওয়া, কবরস্থান দখল, অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রম, পরিবেশ দূষণ ও হয়রানি ইত্যাদি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডেরা কর্তৃপক্ষ জোর করে কৃষিজমি দখল করেছে।

 

তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভূমি ব্যবহার আইনসহ একাধিক সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। কৃষিজমিতে  রিসোর্টের ভিলা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫-২০ বিঘা জমি অবৈধ দখল, আর মৃতদের শান্তির ঘর, সেই কবরস্থানও রেহাই পায়নি। হরিণের খাঁচা বানাতে দখল হয়ে গেছে ১০০ থেকে ১৫০টি কবরের জায়গা।

 

স্থানীয় আলেম সমাজ ও এলাকাবাসীর ক্ষোভ, ডেরার ভেতরে চলে উচ্চস্বরে গান-বাজনা, নাচ, জুয়া, মদের আসর। যুব সমাজ ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে এসব অপকর্ম। জন্মদিনের নামে মদের গ্লাস ঠোকাঠুকি, রাতভর বেহালার সুরে লালসার নৃত্য—এসব নাকি নিয়মিত চিত্র। অথচ কর্তৃপক্ষ মুখে বলে, সবই বৈধ, সবই বিনোদন।

 

হযরত আলী, ইসমাইল ও মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ লিটন মোল্লাসহ ১৩ জন ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ ও তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া জবানিতে দাবি করেন- তাদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা টাকার দাবি করলে ডেরা রির্সোট তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করেছে।

 

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এই রিসোর্ট কোনোভাবেই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর—সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সরেজমিন যে চিত্র দেখেছেন, তাতে ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

 

ডেরা রির্সোটের ম্যানেজার (অপারেশন) ওমর ফারুকের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হলে তিনি যুগান্তরকে জানান, তারা এখনো তাদের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের চিঠি পাননি।

 

এর আগে স্থানীয়রা একাধিকবার মানববন্ধন করে এ রিসোর্ট বন্ধের দাবি তুলেছিলেন। প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলেন। অবশেষে তদন্ত শেষে যখন ‘লাইসেন্স স্থগিত করার’ সুপারিশ করা হলে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে।

 

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহকারী নিয়ন্ত্রক (সিনিয়র সহকারী সচিব) শেখ রাশেদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনা পত্র পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়ন করা হবে।