
মৌলভীবাজারে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে একটি চক্র। গুদামে পর্যাপ্ত সার মজুত থাকলেও বাজারে হাহাকার। রোপা আমনের এই ভরা মৌসুমে ধান বাঁচাতে মরিয়া কৃষক এখন জিম্মি হয়ে পড়েছেন আওয়ামী ডিলার সিন্ডিকেটের হাতে। ‘সার নেই’ নাটক সাজিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতি বস্তা ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের জন্য অতিরিক্ত ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় আবার নির্ধারিত পরিমাণ সরবরাহও মিলছে না। ফলে মৌসুমের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেচ ও পরিচর্যার কাজে সমস্যায় পড়ছেন কৃষক।
মৌলভীবাজার জেলার ২০২৫-২৬ সালের বিসিআইসি সার ডিলারদের রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিলারশিপ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে বেশিসংখ্যক পতিত সরকারের দোসররা রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার ৫৩ ডিলারের মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজার সদরের শেরপুরের মেসার্স রহমান বীজঘর অ্যান্ড কৃষি মেডিসিন সেন্টার, সরকার বাজারের রাহী এন্টারপ্রাইজ, নতুন ব্রিজের আলহাজ মাসুক ট্রেডার্স, কাগাবালা বাজারের সানি এন্টারপ্রাইজ, কাজির বাজারের তন্ময় ট্রেডার্স, একাটুনার রুহিদ পোলট্রি ফিড অ্যান্ড তানিম এগ্রো ফার্ম, শিমুলতলা বাজারের সারঘর, দিঘীরপাড় বাজারের মাহবুবুর রহমান, গোবিন্দপুর রাজারের তাওসিফ ট্রেডার্স, কোদালীপুলের ইমরান অ্যান্ড ব্রাদার্স, গিয়াসনগরের মনু এন্টারপ্রাইজ, সৈয়দ কুদরত উল্ল্যা সড়কের এম এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট, শ্রীমঙ্গল মির্জাপুরের জলি এন্টারপ্রাইজ, ভূনবীরের ইকো এগ্রিকালচার স্টোর, শ্রীমঙ্গল শহরের জননী এন্টারপ্রাইজ, সিন্দুরখানের মিতালী এন্টারপ্রাইজ, কালাপুরের সায়মা ট্রেডার্স, আশিদ্রোনের মনমোহন ট্রেডার্স, রাজঘাটের মেসার্স জামান ট্রেডার্স, কালিঘাটের উত্তরা ট্রেডার্স, সাতগাঁওয়ের রাহুল ট্রেডার্স, পৌরসভার সোহেল এন্টারপ্রাইজ, রাজনগর মুন্সিবাজারের অর্নব এন্টারপ্রাইজ, গোবিন্দ বাটির পিআর এন্টারপ্রাইজ, সদরের ফরাজী এন্টারপ্রাইজ, হরিপাশার আরক অ্যান্ড ব্রাদার্স, তারাপাশার গৌরাঙ্গ অ্যান্ড সন্স, কমলগঞ্জ বাবুবাজারের রাফি এন্টারপ্রাইজ, নয়াবাজারের মুক্তা এন্টারপ্রাইজ, শমসেরনগর বাজারের এম হাসান এন্টারপ্রাইজ, ভানুগাছা বাজারের চৌধুরী ট্রেডার্স, শমসেরনগর বাজারের কৃষি ঘর, আদমপুর বাজারের মেসার্স খান অ্যান্ড সন্স, নাঈম এন্টারপ্রাইজ, ভানুগাছ বাজারের জননী এন্টারপ্রাইজ, মুন্সিবাজারের আকবর হোসেন, কুলাউড়ার দক্ষিণ বাজারের ডিলমন স্টোর, চৌমুহনার নেছার এন্টারপ্রাইজ, নবাবগঞ্জ বাজারের খান ট্রেডার্স, বরমচাল বাজারের মেসার্স মিন্টু ট্রেডার্স, ব্রাহ্মণ বাজারের কৃষি বিতান, টিলাগাঁও বাজারের সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ, রবির বাজারের শাপলা অটো রাইস মিল, পীরের বাজারের তাহির ট্রেডার্স, উত্তর কুলাউড়ার বেলাল ট্রেডার্স, কটারকোণা বাজারের রুহিন ট্রেডার্স, ভাটেরা স্টেশন বাজারের কাদির মিয়া অ্যঅন্ড সন্স,
দক্ষিণ শাহবাজপুরের মেসার্স রাজ ট্রেডিং, সুজানগরের জমির ট্রেডার্স, কাঠালতলী বাজারের হাসান ট্রেডার্স, দক্ষিণভাগ বাজারের কৃষি এন্টারপ্রাইজ, বড়লেখার পকুয়া এন্টারপ্রাইজ ও ভবানীগঞ্জ বাজারের মেসার্স মিতালী স্টোর অ্যান্ড বীজ ঘর।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০ হাজার হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ইউরিয়া চার হাজার ২৯৬, টিএসপি ৫৯০, ডিএপি এক হাজার ৪১৯, এমওপি ৮ ৪০ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে ডিলাররা উত্তোলন করেছেন ইউরিয়া দুই হাজার পাঁচ, টিএসপি ৩৩৮, ডিএপি ৭২০, এমওপি ৪৭১ মেট্রিক টন। মজুত আছে ইউরিয়া এক হাজার ২৬, টিএসপি ১৭০, ডিএপি ২১৫, এমওপি ২০৮ মেট্রিক টন সার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুদামে এখনো মজুত আছে বিপুল পরিমাণ সার; কিন্তু বাজারে সংকট তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। জেলার ৫৩ ডিলারের সবাই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০২৫-২৬ সালের জন্য তাদের ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সদর উপজেলার নতুন ব্রিজের মেসার্স আলহাজ মাসুক ট্রেডার্সের মালিক বর্তমান পলাতক আওয়ামী চেয়ারম্যান আপ্পান আলীর আত্মীয়। জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদধারী নেতা, তাদের ভাই, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের নামেই সারের ডিলারশিপ রয়েছে। একই অবস্থা সারা জেলায়ই।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলারদের হাতেই গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কৃষকদের জিম্মি করে ফেলেছে।
মৌলভীবাজার সদরের জগৎপুর গ্ৰামের কয়েছ আহমদ বলেন, আমাদের ধান এখন সার ছাড়া বাঁচানো কঠিন। কিন্তু বাজারে গেলেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে নিতে হচ্ছে।
শ্রীমঙ্গলের ভুনবীর ইউনিয়নের ভিমসি গ্রামের কৃষক মহরম আলী, নাসির, মান্নান, বেলাল ও অজিউল্লাহ ইউরিয়া সার না পাওয়ার অভিযোগ করে বলেন, আমন রোপণ শেষ হয়েছে অনেক আগেই; কিন্তু এখন টিএসপি সার মিলছে না কোথাও। তবে মোটা অঙ্কের টাকা দিলেই মিলছে সার। এগুলো বস্তাপ্রতি এক হাজার ৮০০ টাকা। এর জন্য ক্যাশমেমো চাইতে গেলে ডিলাররা তা দিচ্ছেন না। সার চাইতে গেলে ডিলাররা বলেনÑবরাদ্দ নেই।
কৃষকরা জানান, এক হাজার ৩৫০ টাকায় সার বিক্রি করার কথা থাকলেও তা ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে; তাও এক থেকে দুই বস্তা। এর জন্য ডিলারদের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করতে হয়।
সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের উলুয়াইল গ্রামের কৃষক শেখ ইমাদ উদ্দিন বলেন, বাজারে কোনো সার পাওয়া যাচ্ছে না। ডিএপি সার খুঁজছি, ডিলারদের কাছে ধরনা দিচ্ছি। কেউই সার দিতে পারছে না। তিনদিন পর অন্য এক মাধ্যমে দুই বস্তা সার পেয়েছি।
শ্রীমঙ্গলের কৃষি কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিলারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে বাজারে সমস্যা। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জালাল উদ্দীন বলেন, কোথাও কোথাও সংকট থাকতে পারে, সারের বড় কোনো সংকট নেই। জেলার সবগুলো উপজেলায় পর্যাপ্ত সার মজুত রয়েছে।
জেলা প্রশাসক ইসরাইল হোসেন বলেন, আমি একটু খোঁজ নিয়ে দেখি সার কোথায় গেল। কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই ডিলারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।