Image description
জুলাই সনদ নিয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো

মাসের পর মাস আলোচনার পরও সংস্কার ইস্যুতে এখনো একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আর মতৈক্য না হওয়ায় ঘরের আলোচনা এবার গড়াচ্ছে মাঠের আন্দোলনে। চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি ওঠে সর্বত্র, যা বাস্তবায়নে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে ছয়টিসহ পরবর্তী সময়ে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংস্কার প্রশ্নে দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। তবে আলোচনার শেষদিকে এসেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি দলগুলো। বরং সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার এবং বহুল আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো বিস্তৃত আলোচনা চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত সোমবার ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত আবারও এক মাস বাড়িয়েছে সরকার।

অন্যদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং এর আলোকে আগামী সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে ৬টি রাজনৈতিক দল। আর এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) কক্ষে কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় মাঠে গড়াচ্ছে নির্বাচনী রাজনীতি। দাবি আদায়ে মাঠের আন্দোলনে নামছে রাজনৈতিক দলগুলো। অবশ্য দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মূলত নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র এবং সরকারকে চাপে ফেলতে এ ধরনের ‘স্ববিরোধী’ কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে দেশে যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল, তা এখনো পুরোপুরি স্থায়ী ঐকমত্যে রূপ নিতে পারেনি, যে কারণে মাঠের আন্দোলন বাড়ছে। তবে এসব কর্মসূচি কিংবা হুঁশিয়ারিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। বরং দলটি আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের অপেক্ষায় আছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সরকারকে চাপে রাখার জন্য নানামুখী তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দলগুলোর কর্মসূচি তারই ইঙ্গিত। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বৃহত্তর স্বার্থে ছোটখাটো বিষয়ে ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজন।

সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসে দীর্ঘ আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। আজ বুধবার আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে কমিশন। দীর্ঘদিন ধরে চলা বৈঠকেও সংস্কার বিষয়ে বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মূলত প্রণয়নের চেয়ে সনদ কার্যকরের পদ্ধতি নিয়েই জটিলতা বেশি। এ অবস্থায় আইনি ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনসহ পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ৬টি রাজনৈতিক দল। এতে অনেকেই মনে করছেন যে, এসি রুমের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় মাঠে গড়াচ্ছে রাজনীতি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমনিতেই সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে আবার বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপিকে জড়িয়ে একটি মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ ছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলে বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের পরাজয়ের পর দলটি চাপে পড়েছে কি না, এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে—বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কারণ ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বড় পরাজয় ঘটেছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে অন্তত ৬টি দল একযোগে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলগুলো যেসব ইস্যুতে মাঠে নামছে, সেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে সরকারবিরোধী মনে হলেও কার্যত বিএনপির বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্দোলন বলে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন। কারণ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের নিষিদ্ধের দাবিসহ আরও দু-একটি ইস্যুতে বিএনপি এখনো একমত হয়নি। অথচ এসব ইস্যুতে ৬টি দল যুগপৎ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিস, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অনেকের মতে, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ জয়ের পর সরকারকে চাপে ফেলার শক্তি জামায়াতের কিছুটা হলেও বেড়েছে। ফলে নির্বাচন, পিআর বা জুলাই সনদ ইস্যুতে তারা আগের তুলনায় বেশি চাপ তৈরি করতে পারে, যা পক্ষান্তরে বিএনপির জন্য চাপ তৈরি করবে। অবশ্য বিএনপি নেতারা বলছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক নয়। বিশেষ করে, গত কয়েকটি নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট রাতারাতি দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যাবে, এমনটিও মনে করার কারণ নেই।

জামায়াতসহ কয়েকটি দলের নেতারা অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষ করে গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর থেকে সরকার বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে চলছে। এ অবস্থায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন না করলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। এই বাস্তবতা সামনে রেখে কয়েকটি দল প্রাথমিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘অবশ্যই যে কোনো দলের কর্মসূচি দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। তারা কর্মসূচি দিতে পারে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজপথের কর্মসূচি দেওয়া অনেকটা স্ববিরোধিতা।’

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের দাবির মধ্যে জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষেও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতির বিষয়টি কখনো ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল না। এখন কোনো দল তাদের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে চাইলে দিতে পারে। কিন্তু জনগণের নামে এক দলের আদর্শ বা দাবি অন্যদের ওপর আরোপ করা কতটা সঠিক, সেটা দেখতে হবে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির (চরমোনাই পীর) বলেছেন, শুধু নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। দেশকে স্থায়ীভাবে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে মৌলিক সংস্কার ছিল এ অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে, যা দেশকে অশুভ বন্দোবস্তে নিপতিত করবে। সরকার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ঘোষণা না দিলে তারা সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।

তিনি আরও বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনকে নিয়ে এ আন্দোলন চলবে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা সরকারকে চাপে রাখতে চান।

এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কোনো দলকে চাপে রাখার জন্য কর্মসূচি দিইনি। বরং টেকসই সংস্কার ও জনগণের কল্যাণের জন্য জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে সেটার অধীনে একটি সুন্দর নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছি।’

সার্বিক বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘১৯টি বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে এত লম্বা সময় নেওয়াটা ঠিক হয়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও মনোমালিন্য বাড়ছে। যেহেতু দলগুলোর নিজস্ব স্বার্থে প্রতিযোগিতা আছে। মূলত ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘসূত্রতার কারণেই সংকট তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন দলগুলোর পরস্পরের দ্বন্দ্বের কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্ব করাটা ঠিক হবে না। নির্বাচন বিলম্ব হলে আরও বহুমুখী সংকট তৈরি হবে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকাটাই একটা সংকট। সম্প্রতি নেপালে বলা হচ্ছে ৬ মাসের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া হবে। কারণ নির্বাচিত সরকার না আসাটাও বড় সমস্যা। সুতরাং দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে অনতিবিলম্বে সংসদ নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সেইসঙ্গে দু-একদিনের মধ্যেই ঐকমত্য কমিশনকে দলগুলোর সঙ্গে বসে দ্রুততার সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি কারও জন্যই সুখকর হবে না।’