
‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামের একটি বাস গত ১৭ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৬০ জন যাত্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হয়। বাসটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের কামারখোলা সেতুতে উঠে একটি কাভার্ড ভ্যানের পেছনে জোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের ছাদ সামনে থেকে ভেঙে পেছনে গিয়ে আটকে থাকে। দুর্ঘটনার পরও চালক বাস না থামিয়ে আরও দ্রুতগতিতে চালাতে থাকেন। পরে ঘটনাস্থল থেকে ১ কিলোমিটার দূরে সমষপুরে বাসের ছাদ উড়ে যায়। তবুও বাস চালিয়ে যেতে থাকেন চালক। সমষপুর পেরিয়ে আরেকটি প্রাইভেট কারকে ধাক্কা দেয় বাসটি। তারপরও চালক বাসটি বেপরোয়াভাবে প্রায় ৬ কিলোমিটার চালিয়ে যান। এ সময় বাসের যাত্রীদের চিৎকার শুনে স্থানীয় জনতা বাসটি আটক করে।
সারা দেশের মহাসড়কে অতিরিক্ত গতির কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সড়কের গতিসীমা নির্ধারিত থাকলেও নিয়ম মানে না কেউ। মহাসড়কে চলাচল করছে তিন চাকার ধীর গতির যানবাহন। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি-অঙ্গহানি ঘটলেও সড়ক আইন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক দুর্ঘটনার মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ৩ হাজার ৩৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৯৪৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৭৮ জন। জানুয়ারিতে ৫১১টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৮৩ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫০১টি দুর্ঘটনায় ৪৮২ জন, মার্চ মাসে ৪৬৩টি দুর্ঘটনায় ৪৪২ জন, এপ্রিলে ৫০৬টি দুর্ঘটনায় ৪৮০ জন। মে মাসে ৫০১টি দুর্ঘটনায় ৪৯০ জন, জুনে ৫৫৭টি দুর্ঘটনায় ৫৬৬ জন মারা গেছেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গতিসীমার যে গাইডলাইন করা হয়েছে সেটা মানার জন্য কিছু বিষয়ে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। কোন সড়কে কত গতিতে যানবাহন চলবে এটা চিহ্নিত করতে হবে। গতিসীমা পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে পর্যাপ্ত প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিতে হবে। রাস্তায় গতি পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ক্যামেরা থাকলেও অতিরিক্ত গতির কারণে জরিমানা করা হয় না। গতিসীমা বাস্তবায়নে নিয়ম অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪ অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাক চলবে ৫০ কিলোমিটার গতিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। অন্যান্য যানবাহনের জন্য এ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যদি কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করে তার বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন অমান্যকারীকে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। এক্সপ্রেসওয়ে ও জাতীয় সড়কে তিন চাকার যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দ্রুতগতির সড়কে যদি ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে তাহলে যে গতির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে। আমরা অনেক সময় দেখি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেছে বা ট্রাক উল্টে গেছে। এর মূল কারণ দ্রুতগতির সড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল।’
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে, চালকের পাশাপাশি সামনের এবং পেছনের সিটে বসে থাকা যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধতে হবে, মোটরসাইকেল চালককে মানসম্পন্ন হেলমেট পরতে হবে এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে শিশুদের জন্য আলাদা সিট সংযোজন করলে দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।’