Image description
♦ দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের ফল শূন্য ♦ বিশেষজ্ঞদের চার বিকল্প পথ নিয়েও বিতর্ক

দুই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে পথচলা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু মত, পথ ভিন্ন হওয়ায় পূর্ণতা পাচ্ছে না প্রস্তাবিত জুলাই সনদ। তাই অনিশ্চয়তা আর সংকটের মুখোমুখি কমিশন। মোটাদাগে দুই কঠিন চ্যালেঞ্জের কোনোটাই এখন পর্যন্ত উতরানো সম্ভব হয়নি। সামনের পথ আরও কঠিন। জুলাই সনদের প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত হলেও এর বাস্তবায়নের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না কমিশন। এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি পথ পাওয়া গেলেও তা নিয়ে উঠেছে বিতর্ক। দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সেখানেও ফল শূন্য। কারণ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নানা পথের কথা বলেছেন। মতের দর্শন দেখিয়েছেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। কমিশন জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চারটি বিকল্প পথ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে-গণভোট, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স মতামত, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা ও অধ্যাদেশ জারি। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অধ্যাদেশে কিছু বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও সংসদ অনুমোদন না দিলে কার্যকারিতা হারাবে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি বলছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে হবে আগামীর নির্বাচন। সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না তারা। আগামী সংসদের হাতে এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন ছেড়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। বর্তমান সরকারের সময় থেকেই এই সনদের বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছে দলগুলো। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করবে জামায়াত। দলটি মনে করে, সনদের বাস্তবায়ন প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না, আইনি ভিত্তি না থাকলে সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এদিকে, জুলাই সনদে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে এনসিপি। বিএনপি বলছে, জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ারের ভিত্তিতেই এই ঘোষণাপত্রকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর চাইতে বড় জাতীয় সম্মতি আর নেই।

অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দাবি, সনদ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণে তারা আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনায় বসবে। প্রথম ধাপের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকের পর, সেই আলোচনার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠক করে সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এরই মধ্যে জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে কমিশন। সনদের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। চূড়ান্ত খসড়ায় বেশ কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে বলে একাধিক দল দাবি করেছে। অসামঞ্জস্যতা দূর করার পাশাপাশি এই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করার দাবিও জানানো হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হলে সংসদে যেতে হবে। খসড়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বাস্তাবায়নের প্রক্রিয়া বলা হয়নি। এর আগেও বেশ কয়েকবার বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা আমরা বলেছিলাম। তারপরও বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা সনদের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়নি। বরং অনেকটা গোঁজামিল দিয়ে দুটি জিনিস নিয়ে আসা হয়েছে। একটা হচ্ছে, যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য হবে সেগুলো নির্বাচনের আগে সরকার বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি এবং সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করবে তাও স্পষ্ট করেনি। একই সঙ্গে কিছু বিষয় অঙ্গীকারনামার প্রথম দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আমাদেরকে ভুল দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা পাঁয়তারা করছে কমিশন। তাই ঐকমত্য কমিশনে যে খসড়া সেটি পেয়ে আমরা হতাশ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সনদ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটি একটি ভয়ংকর বিষয়। বর্তমান সরকারকে দিয়েই সনদ কাজ সম্পন্ন করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংবিধান সংশোধনের অধিকার একমাত্র নির্বাচিত সংসদের।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই সনদের খসড়ায় রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে যেসব সংস্কারে ঐকমত্য ও নোট অব ডিসেন্টসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে একটি পটভূমি, সংস্কার কমিশনসমূহ গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন ও এর কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ঐকমত্যে উপনীত হওয়া বিষয়সমূহ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে।

চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে আলোচনায় ছিল ‘জুলাই সনদ’। ঐকমত্য কমিশনের ৬৮ দিনের বৈঠকেও চূড়ান্ত রূপরেখা দিতে পারেনি। সবমিলিয়ে বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ।