Image description
♦ দুই বছরের রায়ে ২৩৮ মামলায় ১২৩টিতেই খালাস ♦ শতভাগ সাজার হার ৪৮ দশমিক ৩২ শতাংশ

রংপুর মিঠাপুকুর থানায় ২০০০ সালের ১৯ নভেম্বর জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি হত্যা মামলা হয়। প্রায় চার মাস মামলাটির তদন্ত করে পুলিশ। প্রায় ১৫ বছর ধরে বিচার শেষে ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল মামলাটির রায় হয়। রায়ে ৪৩ আসামির মধ্যে একজনকে মৃত্যুদণ্ড, পাঁচজনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের খালাস দেওয়া হয়। এদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানায় ২০১০ সালের মার্চে একটি হত্যা মামলা হয়। প্রায় দেড় বছর মামলাটির তদন্ত করে পুলিশ। তিন বছর বিচারকাজ শেষে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি রায় হয়। রায়ে দুজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

শুধু এ দুটি মামলাই নয় ২০১৫ ও ২০১৬ সালের রায় হওয়া মোট ২৩৮টি হত্যা মামলার মধ্যে ১২৩টিতে মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। শতভাগ সাজা হয়েছে ১১৫টিতে। অর্থাৎ মামলাগুলোতে সাজার হার ৪৮ দশমিক ৩২ শতাংশ।

১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দায়ের হওয়া হত্যা মামলা নিয়ে গত মে মাসে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতিবেদনটিতে হত্যা মামলায় সাজা এবং খালাস হওয়ার হার ফুটে উঠেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সাক্ষীর অভাব, আপস-মীমাংসা, তদন্তে ভুলত্রুটি, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ভুল প্রতিবেদন, এজাহারে ভুল, জবানবন্দিতে ভুল, আসামি মানসিক রোগী হলে কিংবা প্রধান আসামির মৃত্যু, গণপিটুনিতে ভুক্তভোগীর মৃত্যু হলে এবং আসামি পক্ষ সাফাই সাক্ষী দিয়েছে ইত্যাদি কারণে আসামিদের আদালত থেকে খালাস দেওয়া হয়।

সাক্ষীর অভাব, আপস-মীমাংসা, তদন্তে ভুলত্রুটি, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ভুল প্রতিবেদন, এজাহারে ভুল, জবানবন্দিতে ভুল, আসামি মানসিক রোগী হলে কিংবা প্রধান আসামির মৃত্যু, গণপিটুনিতে ভুক্তভোগীর মৃত্যু হলে এবং আসামি পক্ষ সাফাই সাক্ষী দিয়েছে ইত্যাদি কারণে আসামিদের আদালত থেকে খালাস দেওয়া হয়

পিবিআইর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘসময় বিচারকার্যের জন্য বাদী ও সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই সাক্ষী বৈরী হওয়ার সঙ্গে বিচারের দীর্ঘসূত্রতারও যোগসূত্র রয়েছে। মামলার তদন্ত ও প্রসিকিউশনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করে যদি ভবিষ্যতে হত্যা মামলার তদন্ত ও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে সতর্কতা বজায় রাখা হয় তাহলে হত্যা মামলাসমূহের সাজার হার আরও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০০৪ সালে হত্যা মামলা হয় ৩ হাজার ৯০২টি, ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৫৯২টি, ২০০৬ সালে ৪ হাজার ১৬৬টি, ২০০৭ সালে ৩ হাজার ৮৬৩টি, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৯৯টি, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ২১৯টি, ২০১০ সালে ৩ হাজার ৯৮৮টি, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৯৬৬টি, ২০১২ সালে ৪ হাজার ১১৪টি, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩টি, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪টি, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৭টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৯১টি, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯টি এবং ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৮৩০টি হত্যা মামলা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি আছে। দীর্ঘদিন ধরে যখন মামলা ঝুলে থাকে তখন মানুষ নিজেই প্রতিশোধ নিতে চায়।

এদিকে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি সাত বছর আগে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামির মধ্যে তিন আসামির সাজা কমিয়ে রায় দেয় হাই কোর্ট। তাদের মধ্যে দুজনের যাবজ্জীবন ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গত ১৬ মার্চ এক দশকের বেশি সময় আগে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র আয়াজ হক হত্যা মামলায় দেওয়া দুই আসামির সাজা কমানো হয়। এই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইনজামামুল ইসলাম ওরফে জিসানকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তৌহিদুল ইসলামকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এদিকে পিবিআইয়ের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে রায় হওয়া ২৩৮টি হত্যা মামলার মধ্যে সর্বাধিক ২০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এসেছে ময়মনসিংহ এলাকা থেকে। সবচেয়ে কম বরিশাল থেকে এসেছে ৪ দশমিক ২০ শতাংশ। মামলাগুলোর মধ্যে ৬২টি মামলায় পূর্বশত্রুতা থেকে হত্যার ঘটনা, ১৯টিতে পূর্ব-পরিকল্পিত, ২৪টিতে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ, ১২টিতে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ৪০টিতে বৈবাহিক দ্বন্দ্ব, ১৪টিতে ডাকাতি/চুরি/ছিনতাই/অপহরণ, ১১টিতে ঝগড়া কিংবা মারামারি, ১১টিতে আর্থিক কারণে, ৪টিতে খেলা এবং গান শোনাকে কেন্দ্র করে, ৫টিতে নারী নির্যাতনে এবং ১০টি মামলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. জুয়েল মুন্সী সুমন বলেন, আমরা চাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক। হত্যা মামলাগুলোর নেপথ্যে দেখা যায় দলাদলি কিংবা ভিলেজ পলিটিক্স। এজাহার, সাক্ষী না পাওয়া এবং ভুল ময়নাতদন্তের রিপোর্টের কারণে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। যদি এজাহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য সুনির্দিষ্ট হয় তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।