Image description

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের প্রভাবশালী ছয় জেনারেলের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতনের পর ওই অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধান শেষপর্যায়ে এনেছেন তারা। এই কর্মকর্তারা জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে জানায় দুদক।

এই ছয় সেনা কর্মকর্তা হলেন, সাবেক সেনাপ্রধান ও রাতের ভোটের অন্যতম কারিগর আজিজ আহমেদ, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হান্নান, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জোবায়ের, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) মুজিবুর রহমান ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সেনা কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবের লেনদেন, সম্পদ, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি দেখে তদন্তকারী কর্মকর্তারা চোখ কপালে তুলেছেন। কেউ আবার নানা কায়দায় বিদেশেও অর্থ পাচার করেছেন। এদের সম্পদের খোঁজ করার সময় তদন্তের স্বার্থে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা তাদের তলব করেছেন। কাউকে কাউকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু, তাদের বৈধ আয়ের উৎস থেকে ওই সম্পদের হিসাবের তথ্য দিতে পারেননি।

দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত সময়ে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের এতগুলো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একসঙ্গে তদন্ত করা হয়নি। এই প্রথম তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তদন্ত শেষে শিগগিরই মামলা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানান, ‘ওইসব সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।’

দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতার পালাবদলের পর ২০১৮ সালের রাতের ভোটের অন্যতম কারিগর সাবেক সেনাপ্রধানের জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে দুদকের কাছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়মের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। হুন্ডি করে বিদেশেও টাকা পাচার করেছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। তদন্ত শেষপর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

দুদক জানিয়েছে, মিরপুর ডিওএইচএস ও নিকুঞ্জে আজিজের একাধিক বাড়ি ও প্লট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শতাধিক জমি রয়েছে।

বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ হাতানোর অভিযোগ পেয়েছে দুদক। ২০১৫ সালের গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তদন্ত করছে দুদক। তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক তানজীর সরকার। দুদক জানিয়েছে, গত ৬ মে হান্নানের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করতে আদেশ দেন আদালত। জব্দ করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় ৬৯৯ দশমিক ২৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় তার স্ত্রীর নামে ২ হাজার ২৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২ দশমিক ৪২ শতাংশ জমি রয়েছে। মিরপুরে একটি নির্মাণাধীন সাত তলা ভবন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ছয়টি হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, আয়নাঘরের কারিগর এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুদক জানিয়েছে, তিনি জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রায় ২২ কোটি ২৭ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। জিয়াউলের নামে আটটি সক্রিয় ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১২০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক জানিয়েছে, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি টিএম জোবায়েরের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে জোবায়েরের বিরুদ্ধে। ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ড লন্ডনে পাচার করার সত্যতা পেয়েছে দুদক। গত ২১ এপ্রিল দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জোবায়েরের ট্রাস্ট ব্যাংকের ৫টি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত। এসব হিসাবে ২৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা রয়েছে। আদালতে দুদকের আবেদনে বলা হয়, ট্রাস্ট ব্যাংকের পাঁচ হিসাবের মাধ্যমে জোবায়ের ও তার স্ত্রী ফাহমিনা মাসুদ অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন।

সূত্র জানায়, ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদুলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ অভিযোগ আসে দুদকের কাছে। গত ৬ জুলাই হামিদুলের চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ বিচারক মো. জাকির হোসেন এই নির্দেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই নির্দেশ দেয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নওশাদ আলী ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎপূর্বক নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন বিষয়ে অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

এ ছাড়া এসএসএফের সাবেক ডিজি মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। দুদক তার নামে ১০টি প্লট, দুটি ফ্ল্যাট ও ৫০ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে। তার ১৬টি ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, প্রভাবশালী এই ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিগত ১৫ বছরে নানা মাধ্যমে অভিযোগ আসে দুদকে। আওয়ামী লীগের আমলে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকায় সেই অভিযোগগুলোর কোনো তদন্ত হয়নি। দুদকে অভিযোগ আসার আগেই সেগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। গত ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই অভিযোগগুলো তদন্ত শুরু করে দুদক।