Image description

চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) ডিলার নিয়োগে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি ডিলার নিয়োগের বিপরীতে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’ হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। আবেদনকারী বেশি হওয়ায় লটারির মাধ্যমে ডিলার নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি মানা হয়নি। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতা থেকে শুরু করে পছন্দের লোকজনকেই দেওয়া হয়েছে ডিলারশিপ। আগের ডিলারদের দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোনো ডিলার নিয়োগ না দিতে উচ্চ আদালত সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন চট্টগ্রাম জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) কে। উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে।

 

সূত্রমতে, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ডিলার নিয়োগে ৪২০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে ৯০টি আবেদন বাতিল হয়। বাকি থাকে ৩২০টি। এসব আবেদনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে গত ৫ মে ১২টি ওয়ার্ডে এবং গত ২৬ জুন ২৯টি ওয়ার্ডে ডিলার মনোনীত করা হয়। সর্বশেষ মনোনীত করা ২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১ ওয়ার্ডে ‘যোগ্যতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান না থাকায়’ সরাসরি নিয়োগ ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয় বলে খাদ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। আর আটটি ওয়ার্ডে একাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান থাকায় লটারির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে- মোহরা, উত্তর কাট্টলী, উত্তর হালিশহর, পাঠানটুলী, উত্তর মধ্য হালিশহর, দক্ষিণ মধ্য হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা।

তবে মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী মিন্টা নামে আবেদনকারী এক বিএনপি নেতা যুগান্তরকে বলেছেন, ৪১ ওয়ার্ডে ডিলার নিয়োগে তুঘলকি কাণ্ড করেছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর। আবেদনকারী বেশি হওয়ার কারণে লটারির মাধ্যমে সবকটি ওয়ার্ডে ডিলার নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে মহররমের ছুটি সামনে রেখে রাতারাতি সিলেকশনের মাধ্যমে পছন্দের লোকজনকে ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ডিলারশিপের বিরুদ্ধে দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। ২১ নম্বর জামাল খান ওয়ার্ড, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে যুবলীগের পদধারী নেতারা ওএমএসের ডিলারশিপ পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, পরিবর্তিত বাংলাদেশে সরকারি অফিসে এমন দুর্নীতি আমরা আশা করিনি। লটারির মাধ্যমে ডিলার নিয়োগ হলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না।

তাপস চৌধুরী নামে ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের এক ওএমএস ডিলার অভিযোগ করেছেন, ‘২০২৪ সালের প্রণীত একটি নতুন নীতিমালার অজুহাতে চট্টগ্রাম নগরীর সব ওএমএস ডিলারকে বাদ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে রিট করলে সরকারের ওই সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। চট্টগ্রামের ৪২ জন ডিলারের পৃথক একটি রিটের আদেশে রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোনো ডিলার নিয়োগ না দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে নির্দেশনা প্রদান করেন হাইকোর্ট। কিন্তু এই নির্দেশনা অমান্য করে ৪১ ওয়ার্ডে নতুন ওএমএস ডিলার নিয়োগ দিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। নতুন নীতিমালার কথা বলা হলেও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের আর কোথাও এভাবে পুরোনো ডিলারদের বাদ দেওয়া হয়নি। তিনি আরও অভিযোগ করেন, নতুন ডিলারদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পরই পণ্য সরবরাহের কথা। এ ক্ষেত্রে চুক্তির আগেই সোমবার থেকে নতুন ডিলারদের অনেকেই ওএমএসের পণ্য তুলেছেন।’

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) ও ডিলার নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব এসএম কায়সার আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘নীতিমালা মেনেই ওএমএস ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিক্রয় কেন্দ্রের স্থান বা ওয়ার্ড অফিস থেকে দূরত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে লটারির প্রয়োজন লটারি করা হয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে সিলেকশন করা হয়েছে। ডিলার নিয়োগ কমিটি সর্বসম্মতভাবে এটি করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে ডিলারশিপ পেতে ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’ হয়েছে-এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। কিন্তু এসব অভিযোগে প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। এ ধরনের অন্তত ২০টি অভিযোগ নিয়োগ কমিটি নিষ্পত্তি করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরোনো ডিলারদের রাখতেও বলেননি উচ্চ আদালত, বাদও দিতে বলেননি। বলেছেন, বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী পুরোনো ডিলাররা অটোমেটিকেলি বাদ পড়ে গেছে।’ আওয়ামী লীগ-যুবলীগের পদধারী বা দোসর কাউকে ডিলার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না-এমন সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে আসে তবে সে ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে তাদের কাজ করতে সুবিধা হবে বলেও জানান।

যেসব ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডে ১ জন করে যাদের ওএমএস ডিলার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন, পর্যায়ক্রমিকভাবে-শাহনাজ সুলতানা, মোহাম্মদ ফিরোজ উদ্দিন, মিয়াজী মো. আবুল খায়ের, আছাদ উদ্দিন মোহাম্মদ সাজ্জাদ, মো. আকিবুর রহমান, মো. কপিল উদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম, তসলিমা আক্তার, মো. মিনহাজুল আলম, ইসমাম বিন তাহিদ, মোহাম্মদ রবিউল হোসেন, মো. আরাফাত আকবর চৌধুরী, সামির ইবনে জাকের, সাদিয়া আক্তার, জাহাঙ্গীর আলম, মো. সাইফুদ্দিন চৌধুরী, আবদুল কাদের, মো. নুর ইসলাম রুবেল, মো. শামীম, মো. আবদুস ছবুর, নাসরিন আক্তার, মো. সাহাদাৎ, মো. শফি, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, মো. ওয়াহিদুল আলম চৌধুরী, মো. নুর উদ্দিন, মো. আক্তারুজ্জামান চৌধুরী, মো. হাবিবুল ওয়াজেদ মাসুম, মো. ওমর ফারুক, সাইফুল আজম, মো. তাজউদ্দিন, মো. হাফেজ, মোহাম্মদ জাহেদ আহামদ, সুভাষ চন্দ্র দাশ, আবদুস সাত্তার, মো. রিয়াদ উল হক, মো. শফিকুল হক, মোহাম্মদ রায়হান, রায়হান সাদ্দাম, শাহনেওয়াজ আকিব ও মো. শাহানুর।

এর মধ্যে ২০, ২১, ২৯, ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ যুবলীগ নেতারা ডিলারশিপ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ড যুবলীগের সদস্য তাজউদ্দিনও পেয়েছেন ডিলারশিপ।