
অবশেষে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে ঢাকা ক্লাবে গোপন বৈঠকের ষড়যন্ত্রের হোতাদের। এর মধ্যে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেডের মালিক এবং বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি রাব্বানী জব্বারের প্রতিষ্ঠানসহ ৫০টির মতো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে আতঙ্কে রয়েছেন বিগত ১৫ বছরে মুদ্রণশিল্পের আড়ালে নয়ছয় করে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িতরা।
গত মঙ্গলবার এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে দুদক এনসিটিবি চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে প্রায় ৫০টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—আমিন আর্ট প্রেস, আনন্দ প্রিন্টার্স, অনন্যা, সরকার ও বলাকা প্রিন্টার্স, আনোয়ারা, কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, অনুপম প্রিন্টার্স লি., অটো ও মোল্লা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং প্যাকেজিং, ভাই ভাই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বৃষ্টি প্রিন্টিং প্রেস, দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স, ফাহিম প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, ফায়িজা প্রিন্টিং প্রেস, ফাথিন প্রিন্টিং, ফাইভ স্টার প্রিন্টিং, ফরাজী প্রেস পাবলিকেশন্স, হাওলাদার অফসেট প্রেস, কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেস, দ্য গুডলাক প্রিন্টার্স, আলিফ প্রিন্টিং প্রেস, মেরাজ প্রিন্টিং প্রেস, পানামা প্রিন্টার্স, মৌসুমী অফসেট, জনতা প্রেস, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস, খন্দকার এন্টারপ্রাইজ, প্রিয়াংকা প্রিন্টিং, রেদওয়ানিয়া প্রেস, এসআর প্রিন্টিং, এসএস প্রিন্টার্স, শৈলী প্রিন্টার্স, টাঙ্গাইল অফসেট, সোমা প্রিন্টিং, ভয়েজার পাবলিকেশন্স, রূপালী প্রিন্টিং ও ঢাকা প্রিন্টার্স।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সব স্তরের নতুন বই ছাপাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেওয়া কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র এবং কার্যাদেশ কিংবা চুক্তি অনুযায়ী গৃহীত বইয়ের রিসিভিং কমিটির প্রতিবেদন এবং ছাপানো বইগুলোর গুণগত মান ও স্পেসিফিকেশন পরীক্ষা করা হয়েছে কি না- সে সংক্রান্ত তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি; কার্যাদেশ বা চুক্তির পর কোনো প্রতিষ্ঠানে পরে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে কি না এবং অন্য কোনো চুক্তিপত্র হয়ে থাকলে সে সংক্রান্ত তথ্য বা রেকর্ডপত্র এবং এ ধরনের চুক্তিপত্র হওয়ার আইনগত সুযোগ আছে কি না- সে সংক্রান্ত কারণ ও ব্যাখ্যা উল্লেখসহ তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি; মুদ্রণকারীদের কার্যাদেশ বা চুক্তির শর্ত মোতাবেক যথাসময়ে বিল পরিশোধ করা হয়েছে কি না, বিল পরিশোধে বিলম্ব হলে সে সংক্রান্ত কারণসহ ব্যাখ্যা এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি পাঠাতে হবে।
ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সব স্তরের নতুন বই ছাপাতে এনসিটিবি মনোনীত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানি করা মুদ্রণ কাগজের পোর্ট ড্যামারেজ রহিতকরণের কোনো সুযোগ আছে কি না, থাকলে সে সংক্রান্ত তথ্য কিংবা সব রেকর্ডপত্র এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের পোর্ট ড্যামারেজের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে, তার তালিকাসহ (প্রতিষ্ঠানের নাম, ইনভয়েস নম্বর, পরিমাণ, এলসি নম্বর, বিএল নম্বর এবং টাকার পরিমাণ) বিস্তারিত তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি পাঠাতে হবে। এ ছাড়া এনসিটিবির অনুকূলে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠানের তালিকা, ঠিকানাসহ এবং নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এনসিটিবি কর্তৃক অভ্যন্তরীণ বা অন্য কোনো তদন্ত পরিচালনা হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না, সে সংক্রান্ত তথ্য বা রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি পাঠাতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করেছেন। সঠিক তদন্ত হলে অনেক কিছু বের হয়ে আসবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, দুদক থেকে কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমরা চিঠিটি পর্যালোচনা করেছি। যেহেতু অফিসিয়ালি চিঠি দেওয়া হয়েছে, আমরা সে অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করব।
এনসিটিবির অধীন ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে শুরুতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মুদ্রণশিল্পের ছদ্মাবরণে এ ষড়যন্ত্রে মোস্তাফা জব্বারের ভাইসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সক্রিয় নেতাকর্মীরা। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার নিয়ে ঢাকা ক্লাবে গত ২১ জুন একটি গোপন বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ওই বৈঠকে অংশ নিতে ১১৬ ছাপাখানার মালিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেকের মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে এই আমন্ত্রণ জানানো হলেও গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে শেষ মুহূর্তে বৈঠকটি পণ্ড হয়ে যায়।