
ব্যবসায়ীদের সংগঠন বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে ভোটের জন্য গত ২১ জুন তিন সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সভাপতির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার বিরোধিতা করে পরদিন দুপুরে চেম্বারের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ওই তালা এখনও খোলা হয়নি।
চেম্বারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মূলত ভোট ছাড়াই সভাপতির চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত ১১ দিন ধরে তালা ঝুলছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই সংগঠনে ‘ছাত্র-জনতার’ নামে তালা দিয়েছেন তারা। ফলে গত কয়েকদিন ধরে সদস্য ভর্তি, নবায়ন, সার্টিফিকেট অফ অরিজিন প্রদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
চেম্বারের নেতারা জানিয়েছেন, শহরের ঝাউতলা এলাকায় অবস্থিত চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম খায়রুল বাশারের মামা আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল। তালা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন। মূলত হাসান আলীসহ স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতা ভোট ছাড়াই চেম্বার দখল করতে এই কাজটি করেছেন। কোনও ছাত্র-জনতা তালা দেওয়া তো দূরের কথা, তারা কখনও চেম্বারের কার্যালয়ের আশপাশেও আসেনি।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কার্যালয়ে তালা দেওয়ার পর থেকে ব্যবসায়িক সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে সদর থানায় জিডি করেছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানিয়েছি। ১১ দিন অতিবাহিত হলেও তালা খোলার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। পুলিশ প্রশাসনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’
চেম্বারের সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংগঠনটি তৎকালীন সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুর পর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান মিলনের হাতে চলে যায় নিয়ন্ত্রণ। তিনি বিনাভোটে সভাপতির চেয়ার দখল করেন। এর পরের কয়েক বছর চেম্বার তার দখলে ছিল। মিলন তার পছন্দের লোকজন দিয়ে এটি পরিচালনা করেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মিলনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়। এরপর আত্মগোপনে চলে যান। এ অবস্থায় গত ১ সেপ্টেম্বর চেম্বারের সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে সিনিয়র সদস্য সাইরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সদস্যরা নির্বাচনের দাবি জানালে গত ২১ জুন রেজাউল হাসান রানুকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে দেন সাইরুল। হাসান আলী নির্বাচন ছাড়াই চেয়ার দখল করতে পরদিন তালা দেন।
এ বিষয়ে চেম্বারের সচিব মাসুদ রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ২২ জুন দুপুর দেড়টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী চেম্বারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। এতে নেতৃত্ব দেন আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল। তাদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর তারা কার্যালয়ে তালা দিয়ে চলে যান। ঘটনার পরদিন এ বিষয়ে সদর থানায় জিডি করেছি। সেইসঙ্গে গত ২৮ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে উল্লেখ করেছি, চেম্বার তালাবদ্ধ থাকায় সদস্য ভর্তি, নবায়ন, রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সার্টিফিকেট অব অরিজিন প্রদানসহ সব কার্যক্রম বন্ধ আছে। অবিলম্বে তালা খুলে দিয়ে অচল অবস্থা নিরসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ চেয়েছি। কিন্তু এরই মধ্যে ১১ দিন পার হলেও কোনও সমাধান হয়নি।’
বগুড়ার অন্যতম রফতানিকারক হাসান জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেম্বারের সাবেক পরিচালক হাসান জুয়েল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চেম্বার তালাবদ্ধ থাকায় পণ্য রফতানির জন্য সার্টিফিকেট নিতে পারছি না। এখান থেকে সার্টিফিকেট নিতে ৫০০ টাকা লাগতো। এখন বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে নিতে শুধু
সময়ের অপচয় নয়; চার হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য ভোগান্তি ছাড়া কিছুই নয়।’
শহরের ব্যবসায়ী আজিজ আহমেদ রুবেল বলেন, ‘সদস্য নবায়নের জন্য গত কয়েকদিন ধরে চেম্বারে ঘুরছি। কার্যালয় তালাবদ্ধ থাকায় সদস্য পদ নবায়ন করতে পারছি না। আমার মতো আরও অনেকে ঘুরছেন।’
চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তা বন্ধ করে দিতে কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই কাজে ছাত্র-জনতার সংশ্লিষ্টতা নেই। তালা দেওয়ায় শুধু নির্বাচন বন্ধ নয়; সব কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আশা করছি, এ ব্যাপারে শিগগিরই কোনও পদক্ষেপ নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।’
চেম্বারের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, গত ১৫ মে দুপুরে বগুড়া ডায়াবেটিক ও স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালের আহ্বায়ক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন মুকুলের অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন বিএনপির নেতারা। একইসঙ্গে নামফলকও খুলে ফেলা হয়েছিল। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ উন নবী সালাম ও কে এম খায়রুল বাশার ডায়াবেটিক হাসপাতালে গিয়ে মুকুলের কক্ষে তালা দেন এবং নামফলক খুলে ফেলেন। একইভাবে গত ২২ জুন দুপুরে শহরের ঝাউতলা এলাকায় চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দেওয়া হয়। আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান ও চেম্বারের সাবেক পরিচালক হাসান আলী আলাল তার মামা জেলা বিএনপি নেতা খায়রুল বাশারের প্রভাব দেখিয়ে এ তালা দেন।
অভিযোগের বিষয়ে হাসান আলী আলাল বলেন, ‘চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার লোকজন তালা দেয়নি। চেম্বার দখলের ইচ্ছেও নেই। একটি মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে।’
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম খায়রুল বাশার বলেন, ‘হাসান আলী আলাল আমার মামা, তাই অনেকে মনে করতে পারে, আমি চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দেওয়ায় তাকে সহায়তা করেছি। বাস্তবে এ বিষয়ে কিছুই জানি না। প্রতিপক্ষের কেউ তাদের ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে মিথ্যাচার করছেন।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বগুড়া জেলা শাখার সদস্যসচিব সাকিব খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চেম্বারের কার্যালয়ে তালা দেওয়ার ঘটনায় আমাদের সংগঠনের কেউ জড়িত নয়। সেখানে বিএনপির লোকজন তালা দিয়েছেন বলে শুনেছি।’