
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর একটি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৬ সালে সংঘটিত এ সাইবার চুরির ঘটনা গোটা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। বহুল আলোচিত এ ঘটনার আট বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি শেখ হাসিনা সরকার। উল্টো প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে তদন্তের গতিপথ বদলে দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল রিজার্ভ চুরির ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। তদন্ত ও বিচারের আওতায় আসবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অপরাধীরা। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পার হতে চললেও এ বিষয়ে এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। চলতি বছরের ৩ মার্চ এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠন হলেও সেটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ছয় সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের ওই কমিটির দায়িত্ব ছিল তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ দেয়ার। চার মাস পেরোলেও রিজার্ভ চুরির রহস্য উদ্ঘাটনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালানো হয় ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করতে সক্ষমও হয় অপরাধীরা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে একটি কমিটি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ওই বছরেরই ২০ মার্চ কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে একই বছরের ৩০ মে তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও সেটি আর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি এক দশক হতে চললেও রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরই মধ্যে ৮৬তম বারের মতো আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পিছিয়েছে সংস্থাটি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার আট মাস পর গত ৩ মার্চ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে সভাপতি করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর; বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক এবং রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল হুদা। তিন মাসের মধ্যে কমিটিকে সুপারিশ দিতে বলা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো উচ্চপর্যায়ের ওই কমিটির কাছ থেকে কোনো সুপারিশ পায়নি সরকার।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয় মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আসিফ নজরুলের নেতৃত্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি গঠনের পর এখন পর্যন্ত দুটি সভা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৯ মে। ওই সভার ২৭ দিন পর ২৫ জুন চূড়ান্ত হয় সভার কার্যবিবরণী। সেটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিও শেখ হাসিনার দেখানো পথেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলমান মামলা পরিচালনার আইনজীবীও পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। আজমালুল হক কিউসির পরিবর্তে আইনজীবী নওশাদ জামিলকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে কমিটির সবাই একমত হন। আর চুরির ঘটনার এক দশক পর এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি ও সুইফট সিস্টেম পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগের সুপারিশও এসেছে কমিটির বৈঠকে।
এসব উদ্যোগের বাইরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়েও পর্যালোচনা করেছে আসিফ নজরুলের নেতৃত্বাধীন কমিটি। ২০১৬ সালে দায়ের করা রিজার্ভ চুরির মামলার চার্জশিট এখনো আদালতে দাখিল করতে পারেনি সিআইডি। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছানো হয়েছে অন্তত ৭৫ বার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিবেদন দিতে আরো নয়বার সময় নেয় সিআইডি। তদন্ত প্রতিবেদন জমার দিন ছিল গতকাল। কিন্তু এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান তা দাখিল করতে পারেননি। তাই আদালতের কাছে সময় আবেদন করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক জাকির হোসাইন সিআইডিকে রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আগামী ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি আরো তিন সপ্তাহ সময় পেয়েছে বলে মতিঝিল থানার সাব-ইন্সপেক্টর রুকনুজ্জামান জানান। এ বিষয়ে আদালতে তিনি বলেন, ‘ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর জাকির হোসাইন প্রতিবেদন জমা দিতে আগামী ২৪ জুলাই নতুন দিন ঠিক করে দেন।’
এদিকে পর্যালোচনা কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং অন্যদের বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা চার্জশিট দাখিল করলে একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দায়েরকৃত মামলার ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা, সে বিষয়ে মতামতের জন্য গ্লাডিয়ার্স অ্যান্ড কোং-এর আইনজীবী কারিশমা জাহানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে নিযুক্ত আইনজীবী তার মতামত দিয়েছেন বলে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান “কোজেন ও’কনর”-এর পক্ষ থেকে ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন চাওয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো এ প্রতিবেদন চাওয়া হচ্ছে, নাকি আগেও চাওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির পাশাপাশি সিআইডির তদন্তেও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরে সরকারের শীর্ষ মহলের কেউ জড়িত ছিল কিনা, সেটির বিষয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো তদন্ত হয়নি। এ কারণে রিজার্ভ চুরির মতো এত বড় আর্থিক অপরাধের পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী ও নেপথ্য নায়করা নিজেদের আড়াল করতে পেরেছেন।
শেখ হাসিনার সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সিআইডির যুক্তি ছিল, ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন কিংবা সিআইডির চার্জশিট আদালতে দাখিল হলে চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আর থাকবে না। তখন ফিলিপাইনের সরকারসহ বিবাদীরা দাবি করবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ কর্মকর্তারাই চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। এখন আসিফ নজরুলের নেতৃত্বাধীন কমিটিও একই পথে হাঁটছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মানবাধিকারকর্মী এবং পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান যদিও মনে করেন, রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরত আসুক বা না আসুক, আগে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। এটি না হলে ব্যাংক খাত সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সেগুলো আলোর মুখ দেখবে না। ব্যাংক খাতে সুশাসনও ফিরবে না। নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ছিল দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি। এ ঘটনাটির পর দেশের পুরো ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠন বেড়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট অলিগার্করা একের পর এক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে লুটপাট চালিয়েছে। একদিকে চুরির টাকা ফেরত আসবে বলে কালক্ষেপণ করা হয়েছে, অন্যদিকে নতুন করে চুরির পথ তৈরি করা হয়েছে। আমি মনে করি, টাকা ফেরত আসুক বা না আসুক সবার আগে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের আর্থিক খাতের অপরাধীদের কাছে একটি কঠোর বার্তা যাবে যে চুরি করে পার পাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে।’
হ্যাকাররা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়। এর মধ্যে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়, আর ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় শ্রীলংকার একটি ব্যাংকে। তবে হ্যাকারদের বানান ভুলের কারণে শ্রীলংকার ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর আটকে যায়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন থেকে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট ৬৬ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারের বিষয়টি বর্তমানে ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
ঘটনার পর ওই বছরের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপপরিচালক (হিসাব ও বাজেটিং) জোবায়ের বিন হুদা মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ আট বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় মামলাটির অগ্রগতি নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে না পারার বিষয়ে জানতে গতকাল কমিটির প্রধান ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট থাকায় কমিটির অন্য সদস্যরাও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে গত ২৯ মে পর্যালোচনা কমিটির দ্বিতীয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রায় এক দশক ধরে এ মামলার তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি।’