
দেশে ১৫ বছর কিংবা এর বেশি বয়সী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩৩ লাখ ৭৯ হাজার । তবে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর মাত্র ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশকে শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে । এ ছাড়া শ্রমশক্তি হিসেবে প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণ তো আরও হতাশাজনক — মাত্র ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ( বিবিএস ) ‘ ডিজঅ্যাবিলিটি ইনসাইটস ফ্রম লেবার ফোর্স সার্ভে -২০২২ ( ডিআইএলএফএস ) ’ -এ চিত্র উঠে এসেছে ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন , প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তি এখনো সীমিত ; বিশেষ করে নারীর অংশগ্রহণ , প্রশিক্ষণ ও আয় — সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে । জরিপের তথ্যগুলো দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা । তাঁরা বলছেন , প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি , প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে না পারলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে শ্রমবাজার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে । গত ১৬ জুন বিবিএসের ওয়েবসাইটে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় । জরিপের জন্য প্রথমে মোট ১ হাজার ২৮৪ টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিট ( পিএসইউ ) এবং প্রতিটি পিএসইউ থেকে ২৪ টি পরিবার নির্বাচন করা হয় । সারা দেশে মোট ১ লাখ ২৩ হাজার ২৬৪ টি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয় । তথ্যের আলোকে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে ।
জরিপের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আজিজা রহমান বলেন , প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে । এতে কর্মসংস্থান , বেকারত্ব , শিল্প ও পেশা অনুযায়ী কর্মসংস্থান , চাকরির ধরন , অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান , তরুণদের শ্রমশক্তি , শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ হার , গড় সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা , মাসিক উপার্জন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । জরিপে দেখানো হয়েছে , দেশে ১৫ বছর এবং এর চেয়ে বেশি বয়সী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩৩ লাখ ৭৯ হাজার । তাদের মধ্যে ১৮ লাখ ১২ হাজার পুরুষ এবং ১৫ লাখ ৬৭ হাজার নারী । অর্থাৎ , মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৫৩ দশমিক ৬২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ নারী । এর মধ্যে শহরে বাস করে ৮ লাখ ৭৮ হাজার এবং গ্রামে ২৫ লাখ ১ হাজার জন ।
জরিপে বলা হয়েছে , পুরুষদের তুলনায় নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ অনেক কম । প্রতিবন্ধী নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার মাত্র ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ , যেখানে পুরুষদের হার ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ । শিক্ষায় চিত্র আরও হতাশার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৬৩ শতাংশ এখনো নিরক্ষর । মাত্র শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ কোনো ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ পেয়েছে । পুরুষদের মধ্যে প্রশিক্ষণের হার কিছুটা বেশি ( শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ ) হলেও নারীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ । কৃষি , গার্মেন্টস ও বিদেশি ভাষা — এই তিন খাতে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা । নারীরা সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অকৃষি কার্যক্রম এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে । প্রশিক্ষণের বড় অংশই আসছে সরকারি প্ৰতিষ্ঠান থেকে ।
কর্মসংস্থানে বৈষম্য
জাতীয়ভাবে কর্মজীবী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গড় মাসিক আয় ১০ হাজার ৪৭০ টাকা । শহরে এই আয় ১১ হাজার ৫৫২ টাকা এবং গ্রামে ৯ হাজার ৪১৭ টাকা । নারী ও পুরুষের মধ্যে আয়ের ব্যবধানও স্পষ্ট — প্রতিবন্ধী নারীদের চেয়ে প্রতিবন্ধী পুরুষেরা বেশি আয় করছেন । সপ্তাহে কাজের গড় সময়ও কম । প্রতিবন্ধী পুরুষেরা সপ্তাহে গড়ে ৪৪ ঘণ্টা কাজ করেন আর প্রতিবন্ধী নারীরা করেন মাত্র ৩১ ঘণ্টা । শহরে এই সময় কিছুটা বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলে তা আরও কম । জাতীয়ভাবে কর্মজীবী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাত্র ১২ দশমিক ৮১ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন । পুরুষদের এই হার ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ হলেও নারীদের মধ্যে তা ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ মাত্র । বাকিরা সবাই অনানুষ্ঠানিক খাতেই কর্মরত ।
এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক ( প্রতিষ্ঠান ) সমীর মল্লিক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে শিশুসহ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার জন । এই জনগোষ্ঠীকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা দিচ্ছে । কর্মমুখী করতে দেশের ৬ টি বিভাগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে । প্রয়োজনে আর দুটি বিভাগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে । তিনি আরও বলেন , যদি প্রয়োজন হয় , প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত করতে আরও প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে ।
প্রশিক্ষণে পিছিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ এখনো নিরক্ষর । মাত্র শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পেশাগত কোনো প্রশিক্ষণ পেয়েছেন , যার মধ্যে পুরুষ শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ এবং নারী শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ । প্রশিক্ষণের মধ্যে কৃষি ও পোশাক খাত সর্বাধিক জনপ্রিয় ।
নারীদের মধ্যে অকৃষিকাজ , স্বাস্থ্যসেবা ও গার্মেন্টস খাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তের হার তুলনামূলক বেশি । জরিপ অনুসারে , সবচেয়ে বেশি ৫১ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন । বেসরকারি সংস্থা থেকে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন । প্রতিবন্ধী নারীদের প্রশিক্ষণে এনজিও ও বেসরকারি উৎসে নির্ভরতা তুলনামূলক বেশি । প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আর্থিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ( সিপিডি ) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে । তিনি বলেন , বিবিএসের প্রতিবন্ধী জরিপ আরও বাস্তবতার নিরিখে হওয়া উচিত । কারণ , প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বেকারের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে , তা প্রকৃত অবস্থার চিত্র নয় । যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কাজ খুঁজতে যান না , তাঁদের তথ্য এই জরিপে নেই । যাঁরা কাজ খুঁজেছেন বা কাজ করছেন , তাঁদের কথা তুলে ধরা হলে দেখবেন , বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি ।