Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার পরও সরকারি তালিকায় নাম ওঠেনি ২৩ জনের। দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তারা অভিযোগ করে বলছেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে শহীদদের অন্তর্ভুক্তির আবেদন করা হলেও গেজেটভুক্ত করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও নেওয়া হয়নি। শহীদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া, তাদের পরিবারকে দীর্ঘ অপেক্ষায় ফেলেছে।

যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত হলেও গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন ১০ জনের তালিকা তারা পেয়েছেন। তাদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ২৩ জনের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

এ পর্যন্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮৩৪ জনের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার কথা জানান। এ ছাড়া প্রতিটি পরিবার মাসে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ ভাতা পাবেন বলে জানান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জুলাই গণঅভ্যুত্থান শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ২৩ জনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তারা কোথায় শহীদ হয়েছেন, কীভাবে হয়েছেন, সে বিষয়টিও অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। আমরা ১০ জন পেয়েছি, যারা শহীদ হলেও নাম গেজেটভুক্ত হয়নি। মঙ্গলবার এ ১০ জনকে গেজেটভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’

এ পর্যন্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮৩৪ জনের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার কথা জানান। এ ছাড়া প্রতিটি পরিবার মাসে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ ভাতা পাবেন বলে জানান তিনি।

শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ‘তারা শুধু শহীদের নামটির গেজেটে অন্তর্ভুক্তি চান। কোনো বড় কিছু নয়, শুধু তার ত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। শহীদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণে সরকারি অনেক সুবিধা ও সম্মান থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তারা এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে নামটি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।

ঢাকায় শহীদ হওয়া সাতজনের নাম নেই গেজেটে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন মো. নুরু বেপারী, মো. নুর হোসেন, মো. নাসির হোসেন, মো. আসলাম, মো. ইউসুফ মিয়া, মো. শাহাবুদ্দিন বাধন এবং শাওন তালুকদার। তবে তাদের কারো নামই গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

শহীদ মো. নুরু বেপারী: বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত পশ্চিম সরালিয়া গ্রামে জন্ম নুরু বেপারীর। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে -উঠার আগেই তিনি চিরতরে তার বাবাকে হারান। তারপর থেকে অসহায় মা ও বড় ভাইয়ের কাছে তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। বড় হয়ে নুরু বেপারী একজন ড্রাইভার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং রাজধানী শহর ঢাকায় এসে কাজ শুরু করেন।

শাহাদত বরণ করার পূর্বে ভাড়ায় চালিত পিকআপ চালাতেন তিনি। তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। মেয়ে বিবাহিতা। একমাত্র ছেলে ইলিয়াস (৩০) এবং স্ত্রীকে নিয়ে মেন্দিবাড়ী বাবুরবাগ এলাকায় দীর্ঘ নয় বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। নুরুর একমাত্র ছেলে ইলিয়াস ভাড়ায় চালিত অটো রিক্সা চালক।

গত বছরের ২০ জুলাই পুলিশ বাহিনী কর্তৃক এক বর্বরতার বলি হন নুরু বেপারী। পেশায় পিকআপ চালক ছিলেন তিনি। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে রায়েরবাগ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা দিয়ে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছিলেন। চারিদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ব্যাপক গোলাগুলি করছিল। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকটি গুলি নুরুর শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। ফলে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন তিনি।’

শহীদ মো. নুর হোসেন: নুর হোসেন ১৯৯৬ সালে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এসএসসি পাশ করার পর তিনি ঢাকার একটি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। পড়শোনার পাশাপাশি তিনি নিজেকে বিভিন্ন সমাজসেবামুলক কাজে নিয়োজিত রাখতেন। তার বাবা আব্দুর রশিদের আকস্মিক মৃত্যুতে তার জীবনে নেমে আসে এক কালো মেঘের ছায়া।

বাবাকে হারিয়ে শহীদ নুর হোসেন এতিম হয়ে যান। মৃত্যুকালে জনাব আব্দুর রশিদ এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। অভাবের সংসারে জনাব আব্দুর রশিদের আয়েই ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার সকল খরচ চলত।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। যাত্রাবাড়ি থেকে গণভবনের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মো. নুর হোসেন। যখন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আসেন তখনই তিনি আক্রমনের শিকার হন। সেখানে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। এক পর্যায়ে শহীদ নুর হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকটি বুলেট এসে তার বুকে লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি উপস্থিত ছাত্র-জনতা তাকে স্থানীয় ডেলটা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

শহীদ মো. নাসির হোসেন: মো. নাসির হোসেন লক্ষ্মীপুরের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মো: রফিকুল ইসলাম ও নাজমা বেগম দম্পতির সন্তান।  তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে সবার বড় নাসির। যাত্রাবাড়ির রায়েরবাগের মাতুয়াইলে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। 

নাসির হোসেন জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। নিজে মাঠে থাকেন নিয়মিত। বাসা থেকে সরবরাহ করেন আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না করা খাবার। তিনি সরবরাহ করতেন ঠাণ্ডা পানিও। ১৯ জুলাই নাসির হোসেন আন্দোলনকারীদের পানি ও রান্না করা খাবার দিয়েছিলেন। ২০ জুলাই তিনি ছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ি রায়েরবাগ পয়েন্টে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে হঠাৎ হামলা করে পুলিশ। আহত হন অনেকেই। নাসির গুলিবিদ্ধ হন, গুলি লাগে তার মাথা ও মুখে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় মুগদা হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ২৩ জুলাই মৃত্যু বরণ করেন।

শহীদ মো. আসলাম: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। তাদের মধ্যে শহীদ মো. আসলাম ছিলেন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী এক ব্যক্তি। শহীদ আসলাম ঢাকা যাত্রাবাড়ির ১৭, উত্তর কুতুবখালি এলাকায় বসবাস করতেন। তার জন্মও এই এলাকায়। তিনি বৃদ্ধা মা মমতাজ বেগম (৩০), বোন শারমিন (৩৪) ও তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে যাত্রাবাড়ি উত্তর কুতুবখালীতে বসবাস করেন। তার দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। 

গত ১৯ জুলাই আসলামের বাসার পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিল অবস্থান করে। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হয়। পুলিশবাহিনী আসলামের বাসার গলিতে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে পুলিশ তার বাসায় ঢুকে পড়ে। এসময় নিজ বাসার সিড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি। কথা না বাড়িয়ে আসলামকে মাত্র এক হাত সামনে থেকে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিটি তার শরীরের বাম পাশের হাত ও কাঁধের সংযোগস্থল ক্ষত-বিক্ষত করে বেরিয়ে যায়। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহের ফিনকি দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হন ইউসুফ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজেকে শামিল করতে তিনি বেরিয়ে আসেন রাজপথে। মাকে বলেন আন্দোলনে ছাত্রদের তিনি পানি পান করাবেন। মা ও স্ত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে আসেন। সন্ধ্যায় একে একে সবাই নিজ ঘরে ফিরছিল। তখনও ফেরেননি ইউসুফ। স্বজনেরা উৎকণ্ঠা নিয়েই খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখেন ধানমন্ডি ৩২ এর পথে। পুলিশ, বিজিবি, আওয়ামী লীগ বাহিনী তখনও গুলি ছুড়ছে আন্দোলনকারীদের দিকে। ধানমন্ডি যেন তপ্ত যুদ্ধের ময়দান। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে রাস্তায় পড়েছিল নিরীহ ইউসুফ। কেউ তার খোঁজ নেয়নি।

ঘাতক পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। বুলেটের বিষক্রিয়ায় তার আঘাতের স্থানটি পুড়ে যায়। সন্ধ্যায় স্বজনরা খুঁজতে বের হন ইউসুফকে। অবশেষে বেওয়ারিশ হিসেবে তাকে শনাক্ত করা হয়। পরে পরিবারের লোকেরা ইউসুফের লাশ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন। পরদিন ৬ আগস্ট জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।

শহীদ মো. শাহাবুদ্দিন: ১৯৮৭ সালে ভোলার চর সামাইয়া গ্রামের আব্দুল কালাম ও মনোয়ারা বিবি দম্পতির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মো. শাহাবুদ্দিন। অভাব অনটনের সংসার সামলানোর জন্য ৬৩ বছর আগে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে ভাতের হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন শাহাবুদ্দিনের পিতা। শাহাবুদ্দিন ও তার স্ত্রী একসাথে বাবা-মায়ের সাথেই ঢাকার ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। বাবার ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি সিএনজি চালিয়ে সংসারের খরচ বহন করতেন।

৫ আগস্ট পূর্ব ঘোষিত 'মার্চ ফর ঢাকা' সফল করার লক্ষ্যে ব্যবসায়ী পিতা আবুল কালাম ও শাহাবুদ্দিন দোকান বন্ধ করে ছাত্র জনতার গণ আন্দোলনে যোগ দেন। দুপুর বেলায় খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের শিশু-কিশোর নারী-পুরুষ বিজয়োল্লাসে রাজপথে নেমে আসে। 

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শেরে বাংলা নগর চৌরাস্থার সার একটি বিজয় মিছিল চলছিলো। মিছিল শেরেবাংলা নগর থানার সামনে আসলে ফ্যাসিস্ট পুলিশ বাহিনী এলোপাথাি গুলি ছোড়ে উচ্ছ্বসিত জনতার ওপর। পুলিশের ছোড়া একটি গুলি শাহাবুদ্দিনের মাথায় এসে বিদ্ধ হয় এবং অপর একটি গুলি পায়ে এসে আঘাত করে। তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শাহাবুদ্দিন।

উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে জরুরী ভিত্তিতে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাত সাড়ে ৮টায় কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ বাঁধন: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে শরিয়তপুর জেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের দক্ষিণ মালধ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাঁধন। ছোটবেলা থেকেই তিনি দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছেন। তার পরিবার ছিল অভাব-অনটনে জর্জরিত, যেখানে তার বাবা রোমান হাওলাদার ক্ষুদ্র ব্যবসা করে প্রতিমাসে সামান্য অর্থ আয় করতেন। তার মা বিথী আক্তার গৃহিনী।

পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪, যার মধ্যে বাধনের দুই ভাইও ছিল। বাধনের জীবনে শৈশব থেকেই ছিল দায়িত্বের বোঝা। পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তিনি কম বয়সেই ওয়ার্কশপে কাজ করতে শুরু করেন। তার কাজের মাধ্যমে পরিবারের আর্থিক কষ্ট কিছুটা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পরিবারের অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী।

১৯ জুলাই দুপুরের দিকে বাঁধন ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে ছাত্রদের একটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রতিবাদ করা, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের অধিকারকে দমন করার চেষ্টা হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে ন্যায়ের দাবি তুলে ধরতে রাস্তায় নামে।

বাঁধন মিছিলে সামনের দিকে অবস্থান করছিলেন, তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইতে তার ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ করে পাল্টে যায়। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলতে থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সময় বাঁধন গুলিবিদ্ধ হন এবং গুরুতরভাবে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তাকে দ্রুত সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাকে সুস্থ করে তোলার কিন্তু চরম চেষ্টা সত্ত্বেও ২৩ জুলাই রাত ৯ টা ৩০ মিনিটে বাঁধন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

শহীদ শাওন তালুকদার: সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন আলমারী মিস্ত্রী ছিলেন শাওন তালুকদার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে গোপনে নির্যাতনের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। শাওন তালুকদার পিতা নুরনবী তালুকদার ও মাতা মোসাম্মত বেবির পরিবারে ২০০৩ সালে টাঙ্গাইলে জন্ম গ্রহণ করেন। শাওনের মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বাবা নুরনবী তালুকদার রিক্সা চালক। শাওনের ছোট ভাই নয়ন একজন শ্রমিক। তার ছোট বোন নুরজাহান দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। শাওনের মাসিক আয় ছিল ১৫ হাজার টাকা। তিনি মৃত্যুর ১ সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছিলেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার একদফা দাবীর ফলে খুনি হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরে সাধারণ মানুষের পাশে শহীদ শাওন বিজয় মিছিলে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। জুলাই মাসের আন্দোলনের পরিপূর্ণ তথ্য মিডিয়া গুলো প্রচার না করলেও শাওন তালুকদারদের মতো কিছু দুঃসাহসী তরুণ এগিয়ে আসে। তাদের ধারণ করা ছবি এবং ভিডিও দেখে দেশবাসী আওয়ামী লীগের নির্মমতা বুঝতে পারে।

শাওন অন্যান্য দিনের মতো ৫ আগস্ট বিকাল ৪ টার দিকে পুলিশের জনতার উপরে গুলি বর্ষণের ভিডিও ধারণ করছিলেন। পুলিশ তাকে চিহ্নিত করে এবং তার মাথায় গুলি করে। শহীদ হয়ে যায় শাওন তালুকদার। শাওনের মৃত্যুর খবর কাজলা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তার নিজ বাড়ি ও এলাকায় শোকের মাতম শুরু হয়। কাজলার পাড় কবরস্থানে জানাযা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

চট্টগ্রামে শহীদ হওয়া চার জনের নাম নেই গেজেটে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হওয়া চারজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তারা হলেন- মহিন উদ্দীন, পারভেজ বেপারী, নুর মোস্তফা এবং জাফর আহমেদ।

শহীদ মহিন উদ্দীন: ৫ আগস্ট ঝালমুড়ি বিক্রি করতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। কুমিল্লার অসুখতলায় ঝালমুড়ি বিক্রির সময় অক্রান্ত হন তিনি। পরে কুুমিল্লা সরকারি হাসপাতালে মহিনের লাশ শনাক্ত করে তার পরিবার। মহিনের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল।

শহীদ পারভেজ: গত ১৯ জুলাই রাত ১০টায় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন পারভেজ। সেখান থেকে তাঁর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যান স্থানীয় লোকজন। পরে মরদেহটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মীরা ঢাকার কাকরাইল কিংবা মুগদা এলাকার কবরস্থানে দাফন করেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় কবরটিকে এ পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি স্বজনেরা।

পারভেজের মাতা শামসুন্নাহার বেগম বলেন, দুইদিন পারভেজের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে তার পরিচিত একজন ফোন দিয়ে বলে, পারভেজ গুলি খেয়েছে এবং শহিদের মর্যাদা লাভ করছে। এরই জের ধরে পারভেজের পিতা সবুজ বেপারী গত ২২ জুলাই ঢাকা মেডিকেলের মর্গে যান এবং মৃত মানুষের তালিকায় পারভেজের নাম দেখেন।

শহীদ নুর মোস্তফা: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে সহযোদ্ধার সাথে কক্সবাজারের ঈদগা থানা সংলগ্ন শাহ ফকির বাজার এলাকায় বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বিকাল ৪ টা ৪৫ মিনিটের দিকে মিছিলটির ওপর ঈদগা থানা পুলিশ এলোপাথারি গুলি চালায়। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন নুর মোস্তফা। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে নিকটস্থ মালুমঘাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট ২০২৪ বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন শহীদ জাফর আহাম্মদ ফেনী পৌরসভার সামনে আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন এবং নির্মমভাবে শহীদ হন। শহীদ জাফর তার নিজ বাড়ি ফেনী সদরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। 

সিলেটে শহীদ দুইজনের নাম নেই গেজেটে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া সিলেট অঞ্চলের দুইজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তারা হলেন- মো. মোনায়েম আহমেদ আষাড় এবং পঙ্কজ কুমার কর।

শহীদ মো. মোনায়েম আহমেদ আষাড়: জুলাই বিক্ষোভে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মো. মোনায়েম আহমেদ আষাড়। ২১ জুলাই দেশব্যাপী কারফিউ চলাকালীন সময়ে তিনি এবং তার বড় ভাই তোফায়েল আহমেদ সাইনবোর্ড এলাকায় অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেন। নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক বাহিনী। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে।

মোনায়েম সে মিছিলে প্রথম সারির ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম একজন। ঘটনার এক পর্যায়ে মোনায়েমের পিঠে চারটি এবং তার বড় ভাই তোফায়েলের গায়ে চারটি রাবার বুলেট লাগলে সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পিচ ঢালা রাস্তা রক্তে রঞ্জিত হয়। সাথে থাকা আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা রিকশায় করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রক্তশূন্যতায় তার শরীর নিথর হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। তার আপন বড় ভাই এখনো পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।

শহীদ পঙ্কজ কুমার কর: ৫ আগস্ট খুনি হাসিনার দেশ পলায়নের খবর ছড়িয়ে পরলে সারা দেশে আনন্দ মিছিল বের হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার এর দিকে পঙ্কজ তার এলাকার বন্ধুদের সাথে বিজয় মিছিলে অংশ নেয়। কিন্তু আর বাড়ি ফিরেনি। এদিকে অনেক রাতেও বাড়িতে ফিরতে না দেখে তার পরিবার চিন্তিত হয়ে পড়ে। সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে। পরিবার পরিজনের সাথে আত্মীয়স্বজনরাও যুক্ত হন। তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে ব্যর্থ হয়। কোথাও না পেয়ে সিলেট ওসমানী হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালে খোঁজ করতে থাকেন। 

এদিকে ছেলেকে হারিয়ে মা পাগলপ্রায়। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেন। এভাবে ৩ দিন কেটে যায়। শহীদ পঙ্কজের কোন খোঁজ মেলে না। আগস্টের ৮ তারিখ সকাল সাড়ে দশটার দিকে একটা অজ্ঞাত নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন কল থেকে জানতে পারে কোতোয়ালি থানায় কয়েকটি বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। পঙ্কজের লাশ আছে কিনা এসে দেখতে বলে। আবার কালিঘাটের মসজিদ থেকেও কয়েকটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানানো হয়। 

খবর পেয়ে দ্রুত থানায় যায় শহীদের পরিবার। থানায় গিয়ে অনেকগুলো লাশ দেখে কাত হয়ে যান তারা। এমন ভয়ানক দৃশ্য তারা আগে কখনো দেখেননি। দেয়ালের পাশে ছেলের লাশ দেখে চিহ্নিত করতে আর কষ্ট হয়নি মায়ের। ছেলেকে এমন বীভৎস অবস্থায় দেখে কান্নায় ফেটে পড়েন। তাকে খুব নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতকের দল হায়েনার মত অত্যাচার করেছে শহীদ পঙ্কজকে। ঘাতকেরা হত্যার পূর্বে তার হাত-পা ও বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। তাতেও ক্ষান্ত হননা। বুকের ভিতর বুলেট নিক্ষেপ করে হত্যা করে।

রাজশাহীতে শহীদ হওয়া তিনজনের নাম নেই গেজেটে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হওয়া তিনজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তারা হলেন- মো. রেজাউল হক সরকার, মো. আব্দুল আলীম এবং মো. রিপন ফকির।

শহীদ মো. রেজাউল হক সরকার: ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বড় বোনের বাসা থেকে মাগরিবের নামাজ শেষ করে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন শহীদ মো. রেজাউল হক সরকার। এ সময় আগে থেকে ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় থাকা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দা, কিরিচ, ছুরি নিয়ে তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। মারা গেছে ভেবে তারা রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়। রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট তিনি শাহাদাত বরণ করেন। জানাজা শেষে শিবপুর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ আব্দুল আলীম: আব্দুল আলীম ৪ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মিছিলে। জুলুমের বিরুদ্ধে তুলে ধরেন নিজের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। মিছিলটি সিরাজগঞ্জের এস এস রোডে মাহবুব শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মিছিলে হামলা করে। শুরু হয় প্রচণ্ড সংঘর্ষ। চলে ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি। শহীদ আব্দুল আলীমের সারা শরীর যেন ইট-পাটকেলের আঘাতে ব্যথার স্তুপ হয়ে যায়। বুকে প্রচণ্ড আঘাত পান।

এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করতে শুরু করে। শহীদ আব্দুল আলীম রাস্তায় পড়ে যান। তার ওপর দিয়ে অনেকেই দৌড়ে যায়। পরে তাকে কয়েকজন রিক্সায় করে কোনোমতে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ব্যথায় তাঁর পুরো শরীর শক্ত হয়ে যায়। বাবার এ অবস্থা দেখে ছেলেমেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

রাত যত বাড়তে থাকে তাঁর যন্ত্রণা তত বাড়তে থাকে। এভাবে কেটে যায় দুদিন। তার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। পরে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে এনায়েতপুর হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ৭ তারিখ অর্থাৎ আহত হবার তৃতীয় দিন রাত ১০.২০ মিনিটে শাহাদাত বরণ করেন আব্দুল আলীম।

শহীদ মো. রিপন ফকির: ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার আছড়ে পড়ে ছাত্র-জনতার অন্তরে। আবেগে উদ্বেলিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন বিজয় মিছিলের উদ্দেশ্যে। শহীদ মোঃ রিপন ফকির বিজয় মিছিলের উদ্দেশ্যে বাড়ি হতে বের হন। বিকাল তিনটায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিলটি বগুড়া সদরের চারমাথায় প্রবেশ করলে পুলিশ গুলি, টিয়ারসেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় তার গায়ের উপর একটি টিয়ারসেল পড়ে এবং টিয়ারসেলের ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।

রংপুরে শহীদ হওয়া তিনজনের নাম নেই গেজেটে
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রংপুরের বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হওয়া তিনজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তারা হলেন- আশাদুজ্জামান নূর সূর্য, মো. মোহতামি হাসান ফাহিম এবং মো. রুবাইদুজ্জামান রেজওয়ান নাঈম।

শহীদ আশাদুজ্জামান নূর সূর্য ও শহীদ মো. মোহতামি হাসান ফাহিম: মো. আশাদুজ্জামান নুর এবং  মোহতামি হাসান ফাহিম ৪ আগস্ট বিকেল ৩ টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবানে মিছিলে অংশ নেয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও প্রশাসন যৌথ হামলা চালায়। মিছিলকারীরা এদের হামলায় টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। জনতা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলেও আশাদুজ্জামান ও হামলায় অনেকেই আহত ও নিখোঁজ হয়। 
 
তাদের পৌর মেয়রের বাসায় আটকে রাখে, যার খোঁজ কেউ বলতে পারেনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, তার পরিবার কোন খোঁজ পান। হয় ব্যাপক খোঁজাখুঁজি। প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও কোথাও খোঁজ মেলে না তাদের। অবশেষে পরদিন খবর মেলে হাকিমপুর পৌর মেয়র আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী জাহিদ হোসেনের বাসার ২য় তলার এক রুমে আটকে রাখা হয় মো. আশাদুজ্জামান ও ফাহিমকে এবং সেখানে অগ্নিদম্ব হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তারা। পর দিন সকালে বিনা ময়নামতন্তে আশাদুজ্জামানের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা হাকিমপুর পৌর মেয়ার জাহেদ হোসেনের বাড়িতে হামলা করে আগুন লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, আন্দোলনকারীরা যখন এই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়, তখন হয়তো আসাদুজ্জামানসহ ওই দুজন বাড়িতে আটকা পড়েছিল। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বের হতে না পেরে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়।

শহীদ মো.রুবাইদুজ্জামান রেজওয়ান নাঈম: সেদিন বৃহস্পতিবার, আন্দোলনের কারণে কারখানা ছুটি হয় অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেকটা আগে। তাই সুযোগ পেয়ে আন্দোলনে যোগ দেন রুবাইদুজ্জামান। মুক্তির নেশায় ছুটে যান মিছিলে। আশুলিয়া থানার সামনে যেতেই পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বাধা প্রদান করে ও এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষন করতে থাকে। এক পর্যায়ে একটি গুলি রুবাইদের ডান পাঁজর ভেদ করে। বের হয়ে যায় অপর পাশ দিয়ে।

তৎক্ষণাৎ বাইপাইল নারী ও শিশু হাসপাতালে পাঠানো হলে তারা কোন চিকিৎসা না দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর এক নির্মম বাস্তবতার শিকার হয় রুবাইদুজ্জামানের পরিবার। চারদিকে শুধু আহত মানুষের হাহাকার। 

৪ আগস্ট বিকেলে রুবাইদুজ্জামানকে হাসপাতালে নেয়া হলেও তাকে ভর্তি করায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তার জায়গা হয় ঢাকা মেডিকেলের ফ্লোরে। সেখানে শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা পান তিনি। তাছাড়া অন্য কোন ধরনের কোন চিকিৎসা তিনি পাননি। সারারাত সেখানেই পড়ে থাকেন। পরদিন সকাল ১১ টায় কোন এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি ভর্তির সুযোগ পান। ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে তার অপারেশন হয়।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রুবাইদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এছাড়া অনেকগুলি নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ডাক্তার ও আশঙ্কা মুক্ত হতে পারছিলেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে নিতে পারছিলেন না সঠিক চিকিৎসাও। অবশেষে ৫ আগস্ট রাত আড়াইটায় তিনি মারা যান সঠিক চিকিৎসার অভাবে। পরেরদিন সকালে সেখান থেকে এম্বুলেন্সে করে তার লাশ নেয়া হয় নিজ গ্রামে। ৬ আগস্ট বাদ আছর জানাজা। শেষে তাকে দাফন করা হয় তাদের পারিবারিক কবরস্থান।

ময়মনসিংহে শহীদ হওয়া দুইজনের নাম নেই গেজেটে
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হওয়া দুইজনের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তারা হলেন- মোহাম্মদ জামাল মিয়া এবং রাজু।

শহীদ মোহাম্মদ জামাল মিয়া: ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন জামাল মিয়া শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ন্যায় আর মানবিকতার এই সংগ্রামে তার মতো শ্রমিকদের উপস্থিতি এক নতুন শক্তি এনে দেয়। 

২১ জুলাইয়ের দুপুর ছিল এক অভিশপ্ত সময়, যখন শহীদ জামাল মিয়া নরসিংদির রাস্তায় তার কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। সময় তখন দুপুর ১২টা। হঠাৎ করে গুলির শব্দ শোনা যায়, আর সেই সাথে থেমে যায় তার জীবনযাত্রার ছন্দ। রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। গুলি তার পেটের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। রাস্তায় রক্তাক্ত জামাল মিয়ার নিথর দেহ পড়ে থাকে প্রায় ২/৩ ঘণ্টা ধরে। কেউ এগিয়ে আসেনি, কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তার জীবনপ্রদীপ নিভতে থাকে। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় যেন তার জীবনটা উপেক্ষিত এক গল্প হয়ে যায়, তার কষ্টের সাক্ষী শুধু সেই রক্তাক্ত পথ আর প্রকৃতির নীরবতা।

প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর, তার একজন আত্মীয় ঘটনাস্থলে এসে তাকে দ্রুত নরসিংদির সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তার শারীরিক অবস্থা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। চিকিৎসকরা তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন, তার জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ করা হয়।

ঢাকা মেডিকেলের বেডে শুয়ে থাকা জামাল মিয়া তখনও কিছুটা কথা বলতে পারছিলেন। তিনি জানতেন না, এই কথাগুলোই হতে যাচ্ছে তার জীবনের শেষ কথা। তার প্রতিটি শব্দ ছিল বেদনাবিধুর, তবুও ন্যায়ের পক্ষে তার মনোবল অটুট ছিল। একসময় সেই কথার স্রোত থেমে যায়। ধীরে ধীরে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে হেরে যান তিনি। ২৫ জুলাই সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

শহীদ মো. রাজু মিয়া: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদের আত্মোৎসর্গে পুরো জাতি অনুপ্রাণিত। উত্তাল আন্দোলনে টালমাটাল বাংলাদেশ। স্বৈরশাসনে নিষ্পেষিত জনগণের সামনে আলোর ফোয়ারা দেখা দেয়। সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। হোটেল শ্রমিক শহীদ মোঃ রাজু মিয়াও যোগদান করেন এ আন্দোলনে।

২০ জুলাই সহযোদ্ধাদের সাথে তিনিও রাজপথে ছিলেন। দুপুর সাড়ে বারোটায় খুনি হাসিনার পেটোয়া বাহিনী পরপর পাঁচটি গুলি করে তাকে হত্যা করে। বুকের ডান ও বাম পাশে, মাথায় এবং বাম হাতে দুটি গুলি করা হয়। জনগণ তার রক্তাক্ত দেহটি ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।