
গত ১৯ মে রাতে সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় শহীদ ইয়ামিন চত্বরের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে শাহীন (৩০) নামে এক যুবককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর আগের দিন অর্থাৎ গত ১৮ মে রাতে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার সেন্ট্রাল রোডে এক যুবককে প্রকাশ্যে কোপানো হয়। এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই গত চার মাসে প্রতিনিয়তই খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। যেভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে তাতে সামনের দিনে পরিস্থিতি সামলানো নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে শুধু রাজধানীতেই খুন হয়েছে ১৩৬ জন। সারা দেশে এই সংখ্যা ১ হাজার ২৪৪ জন। যা বিগত বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় এই সংখ্যা ছিল ৫৫ জন, ২০২২ সালে ৫৪ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন এবং ২০২৪ সালে ছিল ৪৭ জন। গত জানুয়ারিতে ঢাকায় খুন হয়েছেন ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে খুন হয়েছেন ৩৮ জন, মার্চে ৩৩ জন এবং এপ্রিলে ২৯ জন। সারা দেশের হিসাবে জানুয়ারিতে ২৯৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮ জন, মার্চে ৩১৬ জন এবং এপ্রিলে খুন হয়েছেন ৩৩৬ জন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, খুনের যে পরিসংখ্যানটা দেখা যাচ্ছে এর সবগুলো হত্যাকাণ্ডই যে এই সময়ের মধ্যে হয়েছে তা নয়। কিছু পুরোনো খুনের ঘটনায় এই সময়ের মধ্যে মামলা হয়েছে। ফলে সেই পরিসংখ্যানও এর মধ্যে চলে এসেছে। আসলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে পুলিশকে খাটো করে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয় তখন অপরাধীরা এই সুযোগটা নেয়। এর বাইরে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য যে ধরনের গোয়েন্দাগিরি বা তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন, সেই জায়গায় আমরা এখনো পৌঁছতে পারিনি। আবার অনেক অফিসারও এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে সবকিছু মিলিয়ে অপরাধপ্রবণতা যে একটু বেড়েছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
সম্প্রতি পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেফতার হলেও অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী অধরা রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিজেদের মধ্যে হানাহানিতেও অনেক খুনের ঘটনা ঘটছে। এই অপরাধ কাজে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার রাত ও বুধবার বিকালে পৃথক অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশ দুই জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন মো. পারভেজ (২৫) ও রিয়াজুর রহমান (২২)। তারা ডাকাতির চেষ্টা করছিলেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। গ্রেফতার দুই জনের কাছ থেকে ধারালো দেশি অস্ত্রসহ একটি রিভলবার ও গুলি উদ্ধার করা হয়। রিভলবার ও গুলি গত বছরের ৫ আগস্ট পাহাড়তলী থানা থেকে লুট হয় বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
গত কয়েক মাসে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি হচ্ছে তাতে সামনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বেশকিছু কারণে এই অবস্থা হয়েছে। পুনর্গঠিত জেলা ও বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে পুলিশকে অবমূল্যায়ন, মব ভায়োলেন্স, পুলিশকে ভয় না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অপরাধের মাত্রা বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেক রাজনীতিবিদও পুলিশকে খাটো করে কথা বলছেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ারা তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করা এসব সন্ত্রাসী তাদের সহযোগীদের দিয়ে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। আবার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে জড়াচ্ছে খুনোখুনিতেও।
এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্টের পরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার কারণে অন্য অপরাধীরাও উত্সাহিত হয়। তারাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, খুন ও আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব অপরাধীর বিষয়ে পুলিশের কোনো নজরদারি নেই। কারণ পুলিশকে বহুমুখী কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রতিদিন আন্দোলন-সংগ্রাম, আসামি গ্রেফতার ও মামলা তদন্ত রয়েছে পুলিশের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরা তাদের সহযোগীদের বার্তা দিচ্ছে। যারা বের হয়েছে তারাও নতুন মেরুকরণে নেমেছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সবকটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামিনে মুক্ত হতে নানা চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। প্রথমে কারাগার থেকে মুক্ত হন কিলার আব্বাস। আরো মুক্ত হন সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু।