Image description
সাবেক রাষ্ট্রপতি হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন । ব্যবহার করেছেন ভিআইপি টার্মিনাল, বিমানবন্দরে ছিলেন প্রায় ৪ ঘণ্টা ।

দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। হত্যা মামলার আসামি হয়েও কীভাবে তিনি দেশ ছাড়লেন তা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল সমালোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুপিসারে নয়, বিমানবন্দরে সব গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই দেশ ছাড়েন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। শুধু নিজে নয়, সঙ্গে নিয়ে গেছেন ছেলে ও শ্যালককেও। ঢাকা ত্যাগের সময় সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করেন এবং বিমানবন্দরের সার্বিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে তিনি প্রায় ৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরে ছিলেন। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের সম্মতি ছাড়া তিনি দেশত্যাগ করেননি। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আবদুল হামিদের দেশত্যাগের বিষয়টি যারা জানার তারা সবাই জানেন। এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে না জানার ভান করা হচ্ছে। তিনি যখন রাত ১১টায় বিমানবন্দরে আসেন তখন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। এখানে সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি তো কোনো অপরিচিত ব্যক্তি নন। তারা বলেন, নিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু তদন্ত হলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। শুধু পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সবাই সবকিছু জানেন।

এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতির পাসপোর্ট ও ভিসা পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পদাধিকারবলে নিয়মানুযায়ী তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল পাসপোর্ট) ব্যবহার করতেন। পরে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট সমর্পণ করে সাধারণ (সবুজ রংয়ের) পাসপোর্ট নেন। সাধারণ পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তিনি ইমিগ্রেশন পার হন। তবে আবদুল হামিদ বিদেশে চলে গেছেন বৃহস্পতিবার এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তার পাসপোর্টের তথ্য তলব করা হয়। পরে পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে আবদুল হামিদ ও তার পরিবারের সব সদস্যের পাসপোর্টসংক্রান্ত তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে এ ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের রহস্যজনক ভূমিকার কড়া সমালোচনা করে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। আবদুল হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার দায়ে ‘ছাত্র-উপদেষ্টা’দের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অপ্রত্যাশিত বলে দাবি করছে সরকার। ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আজহারুল ইসলাম এবং এসবি কর্মকর্তা মো. সোলায়মানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। উক্ত ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এদিকে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় অতিরিক্ত আইজিপিকে (প্রশাসন) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মতিউর রহমান শেখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ‘উনি পাসপোর্ট কিভাবে পেয়েছেন-এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এছাড়া কারা তাকে দেশত্যাগে সহায়তা করেছেন তা খতিয়ে দেখাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

বুধবার রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তিনি বিমানবন্দরে যান রাত ১১টার দিকে। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাত ৩টা ৫ মিনিটের দিকে থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩৪০ নম্বর ফ্লাইটে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। দেশ ছাড়তে কেউ তাকে বাধাও দেয়নি। তিনি নির্বিঘ্নে সসম্মানে গেছেন। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাকে ‘চিকিৎসার জন্য’ যেতে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে শ্যালক ডা. এএম নওশাদ খান ও ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদও ছিলেন। দেশের চিকিৎসকদের পরামর্শেই তিনি বিদেশে গেছেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগের সময় কেউ ‘স্টপ লিস্টে’ আছেন কি না, তা এসবিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা যাচাই করে থাকে। সেখানে সিভিল এভিয়েশনের কোনো কাজ নেই। সিভিল এভিয়েশন শুধু অপারেশনাল দায়িত্ব পালন করে।

বিমানবন্দরে দায়িত্বরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ‘ওনারা চুপিসারে দেশত্যাগ করেছেন-বিষয়টি এমন না। ওই সময় বিমানবন্দরে সব গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কোনো সংস্থার কাছে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না। ফলে সবার উপস্থিতিতেই ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিনি দেশত্যাগ করেন।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল হামিদ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথম দফায় দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয়বার ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর আবদুল হামিদ রাজধানীর নিকুঞ্জের বাসায় উঠেছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি ওই বাসায় আর ছিলেন না। এতদিন কোথায় ছিলেন, তা এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি।

জুলাই অভ্যুত্থানে হামলা ও গুলি করার ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১২৪ জনের বিরুদ্ধে ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। তবে তার দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা কিংবা কোনো বাহিনীর আপত্তি ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। অবশেষে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের নয় মাস পর দেশ ছাড়লেন দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।

এদিকে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি লিখেছেন, ‘খুনিকে দেশ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, পুলিশ আসামি ধরলেও আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়। শিরীন শারমিনকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বাসায় গিয়ে পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল জানুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও মে মাসে এসেও শুরু হয়নি। আর আপনারা বলছেন আওয়ামী লীগের বিচার করবেন? তা ইন্টেরিম, এখন পর্যন্ত কী কী বিচার ও সংস্কার করেছেন?’ এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অফিস থেকে ফোন কল পেয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে এয়াপোর্টে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে পোস্টে লিখেছেন, ‘আবদুল হামিদকে বিমানবন্দরে আটকানো হলো, তারপর নাকি চুপ্পুর অফিস থেকে ফোনকল পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। এরপরও কি ইন্টেরিমকে জুলাই বিপ্লবীরা সাপোর্ট করে যাবে!!! স্যরি, হয় চুপ্পুকে সরান-লীগকে ব্যান করেন, আর না হয় নিজেরা সরে যান।’

ডামি রাষ্ট্রপতি, হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদকে দেশ ছাড়তে সহযোগিতা করায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে গণঅধিকার পরিষদের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন। পরে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, আতাউর রহমান খানের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন। এতে বলা হয়, সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে যথাযথ জবাব, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং ডামি রাষ্ট্রপতিকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সসম্মানে চেয়ার ছাড়তে হবে। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। যার জন্য দায়ী থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এদিকে আবদুল হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার দায়ে ‘ছাত্র উপদেষ্টাদের’ পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ উসমান হাদি বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ছাত্র উপদেষ্টা স্যারেরা, হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার দায়ে আপনারা তিনদিনের মধ্যে পদত্যাগ করুন। এরপর আমরা ইন্টেরিমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামব। হয় গণহত্যার বিচার ও ফ্যাসিস্ট লীগ নিষিদ্ধ হবে, নয়তো ইন্টেরিম বিদায় নেবে। এ দায় থেকে বাঁচার জন্য আপনাদের আমরা সময় দিলাম। যদি সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের কাতারে আসেন, তাইলে সম্মান পাবেন। আর যদি চেয়ার ছেড়ে দিতে কান্না পায়, তাইলে এরপর থেকে আপনাদের ‘তুই’ বলা শুরু হবে! সাথে বঙ্গীয় গাইল।’

‘টক অব দ্য কিশোরগঞ্জ’ : কিশোরগঞ্জ ব্যুরো জানায়, মামলা থাকার পরও আবদুল হামিদ ও তার শ্যালক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রভাবশালী নেতা ডা. নওশাদ খানের বিদেশে পাড়ি জমানোর এ ঘটনা এখন ‘টক অব দ্য কিশোরগঞ্জ’। মামলার আসামি হয়েও সাবেক রাষ্ট্রপতির মতো ব্যক্তি কীভাবে বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগ করতে পারলেন, সেটিই এখন কিশোরগঞ্জের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে মুখে।