
দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয়, বৈশ্বিক ক্রেতার চাহিদা, সক্ষমতাসহ সব কিছু থাকলেও সংকট যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। এটা আরো বড় আকার ধারণ করে ঈদ-রোজা এবং উৎসব-পার্বণ এলে। তবে এবার বড় দুশ্চিন্তার কারণ একই সময়ে দুই মাসের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মজুরি এবং ঈদ বোনাস দিতে হবে কারখানার মালিকদের। এদিকে অনেক মালিক ব্যাংকের ঋণ না পাওয়ায় এই খাত থেকেও সুবিধা নিতে পারছেন না। ফলে এমন ৬০টির বেশি কারখানা বেতন-বোনাস নিয়ে ঝুঁকিতে আছে।
জানা যায়, চলতি বছর ঈদে মালিকদের দুই মাসের বেতন ও বোনাসসহ একটু বেশি চাপ নিতে হবে মালিকদের। এরই মধ্যে সরকারের শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয় ও তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ থেকেও আশঙ্কা করছে, এ বছর ৫০-৬০টি কারখানার মালিক মজুরি পরিশোধে হিমশিম খাবে।
এসব কারখানার অধিকাংশ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হয়েছে। আর এসব ইস্যুকে সামনে নিয়ে শ্রমিক নেতারাও শিগগিরিই মাঠে নামছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের দাবি, ২০ রমজানের মধ্যে বোনাস ও ঈদের ছুটি এবং এর আগে ওভারটাইমের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, এবার ৩০-৪০টি কারখানায় সংকট হতে পারে। তবে শিল্প পুলিশের তথ্য অনুসারে ৫০-৬০টি কারখানা বেতন- বোনাস নিয়ে ঝুঁকিতে আছে। আর এর বেশির ভাগ কারখানাই আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের।
সংগঠনটির একটি সূত্র আরো জানায়, গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফটের দুই হাজার শ্রমিকের মজুরি অন্য সুবিধাসহ ২১ কোটি টাকা পাওনা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক চলছে। একসময় ১০ হাজার শ্রমিক ছিলেন এই কারখানায়। এখনো ৮০০ শ্রমিক কাজ করছেন।
বন্ধ বেক্সিমকোর সংকট মোকাবেলায় সরকারের নিজস্ব তহবিল ৩২৫ কোটি টাকা এবং ২০০ কোটি টাকা তৈরি পোশাক খাতের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে দিচ্ছে সরকার। তবে দুই মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই টাকা ফেরত দেবে। বেক্সিকোর শ্রমিকদের গত ৯ মার্চ থেকে বকেয়া মজুরি দেওয়া শুরু হয়। ওই কারখানার ৩১ হাজার শ্রমিক ও প্রায় দুই হাজার কর্মচারী রয়েছেন।
কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সংকট রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বেক্সিমকো আর কেয়া। রাজনৈতিক সংকটের ফলে এ বড় কারখানাগুলো সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু মালিক সব সময় সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিতে চায়।
বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ হিল রাকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, বেতন ও বোনাস একই মাসে হওয়ায় মালিকদের ওপর একটু চাপ হবে। আর কিছু সংকট কোনো কোনো কারখানার মালিকদের নিজস্ব কারণে। এ সময় ব্যাংকগুলোও খুব একটা এগিয়ে আসেনি। এ কারণে কারো জন্য একটু কষ্টকর হবে।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন, সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নিতে রোজা-ঈদ এলে শ্রমিকদের জিম্মি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন শিল্পের মালিকরা। তাঁরা কর্মসংস্থানের কথা বলে বাড়তি সুবিধা নিতে সরকারের কাছ থেকে এসব সুবিধা আদায় করেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে সাত হাজার কোটি টাকা বিশেষ তহবিল ছাড়ের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের একটি সংগঠন।
শ্রমিক নেতারা আরো বলেন, গত চার দশকে ৫০-৬০টি থেকে পাঁচ হাজার কারখানা হয়েছে। সংকট নেই—এমন কথা কখনোই শোনা যায়নি মালিকদের কাছ থেকে। এই বছরও কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে। সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এটা করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে উৎপাদন ব্যয়, বৈশ্বিক ক্রেতার চাহিদা এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকলেও উৎসবের সময় এলে শ্রমিকদের জিম্মি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন শিল্পের মালিকরা। কর্মসংস্থানের কথা বলে তারা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেন।
বাংলাদেশ পোশাকশিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই এ সময় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের জিম্মি করে সুয়োগ নেন। এ বছরও মালিকদের একটি পক্ষ সরকারের কাছে ১৫ রমজানের মধ্যে সাত হাজার কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে। তাদের দাবি, অর্থ সহায়তা না পেলে ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধে চরম বিপাকে পড়তে পারে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে শঙ্কা বহু কারখানায়
আসন্ন ঈদে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস পরিশোধে সমস্যা তৈরি হতে পারে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের অর্ধ শতাধিক কারখানায়। আর্থিক সংকট, ক্রয়াদেশ না থাকা, পোশাক খাতে অস্থিরতাসহ নানা কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে কারখানাগুলো। শিল্প পুলিশ, কারখানা মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
জানা গেছে, গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে গাজীপুরে বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল গাজীপুরের ৫০টির মতো পোশাক কারখানায়। পাওনা আদায়ে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুরসহ নানা আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। এবারও ওই সব কারখানাতেই সংকট হওয়ার আশঙ্কা।
বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে না পারা এবং অর্ডার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। বেতনের জন্য প্রতি মাসেই আন্দোলনে নামতে হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। প্রায়ই তুচ্ছ ঘটনা এবং নানা গুজব রটিয়ে কারখানা ভাঙচুর, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, গাজীপুরের বহু কারখানায় সমস্যা চলছে। অনেক কারখানায় এখনো ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতি, গ্রেডিং কার্যকর হয়নি। তাই বোনাস প্রদানের সময় এসব ইস্যুতে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, গত ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস প্রদানে অর্ধশাধিক কারখানায় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। ওই সব কারখানার মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে। আসন্ন ঈদে সমস্যা তৈরি হতে পারে—এমন কারখানা চিহ্নিত করার কাজ ১০ রমজানের পর শুরু হবে। বেতন-ভাতা ও বোনাস নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মোতালেব মিয়া বলেন, সমস্যা তৈরি হতে পারে—এমন কারখানার তালিকা তৈরির কাজ এখনো শুরু হয়নি। শিগগিরই শুরু হবে। বেক্সিমকোর বন্ধ কারখানাগুলোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে। তাই এ কারখানা নিয়ে ততটা দুশ্চিন্তা নেই।
সাভার প্রতিনিধি : এদিকে সাভারের একটি গার্মেন্টস কারখানার কোয়ালিটি শাখার শ্রমিক সুরুজ মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বেতন ও কারখানা খুলে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করে আসছি। সর্বশেষ ৪ মার্চ শিল্প পুলিশ মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের ডেকে নিয়ে জানিয়েছে, আগামী ১৫ মার্চ জানুয়ারি মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দেওয়া হবে এপ্রিলের ১০ তারিখে এবং মার্চে কারখানা বন্ধ থাকায় কোনো বেতন দেওয়া হবে না। দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তাই তারা যা বলেছে তাতেই রাজি হয়েছি।
তিনি আরো বলেন, দুই মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। ঘর ভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করতে না পারায় নানা ধরনের কথা শুনতে হয়। তাই আমার ১০ হাজার টাকায় কেনা শখের মোবাইল সাত হাজার টাকা বিক্রি করে বাড়ি ভাড়া ও দোকানের বকেয়া পরিশোধ করেছি। সামনে ঈদ। যদি নির্দিষ্ট তারিখে বেতন না পাই, তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে!
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, বর্তমানে সাভার-আশুলিয়ার ১৮টি কারখানা বন্ধ, যার শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তাঁরা বর্তমানে বেকার জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া শ্রীপুর এলাকার বেক্সিমকো গ্রুপের যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে, তার অধিকাংশ শ্রমিক আশুলিয়ায় থাকে। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ শ্রমিক বেকার। তাঁদের নতুন করে কোনো চাকরি হচ্ছে না।