Image description

গত ফেব্রুয়ারিতে মজুরি প্রবৃদ্ধি কমেছে। ছাড়িয়ে গেছে মূল্যস্ফীতিকে। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় আরও কমেছে। ক্রমবর্ধমান খরচের মধ্যে কম আয়ের মানুষের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মজুরি হার সূচক (ডব্লিউআরআই) অনুসারে—কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬৩টি পেশায় দৈনিক মজুরি পাওয়া অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের মজুরি গত ফেব্রুয়ারিতে আট দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছে। এক মাস আগে তা ছিল আট দশমিক ১৬ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে—২০২১ সালের জানুয়ারির পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবৃদ্ধির হার আগের মাসের তুলনায় কম।

বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে গত মাসে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবধান এক দশমিক ২০ শতাংশ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এটি কম আয়ের ও অদক্ষ শ্রমিকদের খরচ কমাতে বাধ্য করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিবেদনে এ দাবিকে সমর্থন করা হয়েছে।

সংস্থাটি জানিয়েছে— গত বছরের ডিসেম্বরে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখ বেড়ে হয়েছে দুই কোটি ৩৬ লাখ। ২০২৪ সালের অক্টোবরের শেষে তা ছিল এক কোটি ৬৫ লাখ।

'মজুরি কমে যাওয়ায় কম আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব পড়ছে,' উল্লেখ করে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি সুষম খাবার কমাতে বাধ্য করবে। আমিষসমৃদ্ধ ও প্রয়োজনীয় খাবার বাদ পড়বে।'

তবে তিনি মনে করেন, চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'সুস্থ আর্থিক পরিবেশ ও মজুরি বাড়ানো সাধারণত সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে বর্তমান বাস্তবতায় অর্থনীতি গতিশীল নয়।' 'বেশির ভাগ খাতেই প্রবৃদ্ধি স্থবির। যেখানে প্রবৃদ্ধি আছে সেখানে তা ন্যূনতম। এ অবস্থায় মজুরি বাড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান মনে করেন, 'উন্নয়ন খরচের ধীরগতির কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে।'

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি খাতসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনেক কমেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে—রাজনৈতিক অস্থিরতায় উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৫২ শতাংশ।

চাহিদা কমে যাওয়ায় দিনমজুররা বেশি মজুরি পাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক লুৎফর রহমান। তবে গত তিন মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে—ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) জানুয়ারির নয় দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে কমে নয় দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।

মুস্তাফা কে মুজেরি মনে করেন, 'মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়া নীতি-চালিত নয়। সাময়িক বলে মনে হচ্ছে। শীতে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সবজি ও কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। রমজানের পর পণ্যের দাম কম থাকবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।' 'কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বছরের মাঝামাঝি মূল্যস্ফীতির চাপ আবার বেড়ে যেতে পারে।'

তার মতে, মূল্যস্ফীতি রোধে শুধু খুচরা বাজারের ওপর নজরদারি করাই যথেষ্ট হবে না। 'ভোজ্য তেলের কথাই ধরুন। অনেকের যুক্তি, বাজার কারসাজি বা সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের দাম বেশি রাখায় মূল ভূমিকা পালন করে।'

তিনি বলেন, 'দাম কমার জন্য বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। শুধু খুচরা বাজারে নয়।'

'আর একটি উদাহরণ হলো চালের দাম বেশি থাকা। আমনের ভালো ফলন ও সরকারি-বেসরকারিভাবে আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম তেমন কমেনি। এ থেকে বোঝা যায়, বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার ফলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বেশি রাখতে পারছেন।'

'যদি মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকে তবে কম আয়ের মানুষের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এটি অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় অদক্ষতা ও বাজার কারসাজিসহ মূল্যস্ফীতির মূল কারণগুলো সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে,' বলে মন্তব্য করেন মুস্তাফা কে মুজেরি।