Image description

রাজধানীর তুরাগ থানাধীন ধউর এলাকা। এক সময় ঢাকার শেষ প্রান্তের প্রত্যন্ত এলাকা হলেও এখন সিটি করপোরেশনের ৫৪ নং ওয়ার্ড। এখানকার সাধারণ মানুষের ভোগদখলে থাকা অন্তত প্রায় ৫০ বিঘা জমি ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে দলিল অতঃপর চটজলদি নামজারি করা হয়েছে। এ নিয়ে দিনের পর দিন ভোগদখলে থাকা স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের বংশপরম্পরায় পাওয়া জমি কীভাবে রাতারাতি সরকারি কর্মচারীদের সমিতির নামে নামজারি হয়ে যায়। 

গত বুধবার সরজমিন তথ্য সংগ্রহ করে জানা যায়, তুরাগ থানাধীন ধউর এলাকায় সমিতির নামে নামজারি হওয়া জমির পরিমাণ ১৬ একর ৩৫ শতক ৮২ অযুতাংশ। যা প্রায় ৫০ বিঘা। অত্র এলাকায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমিতির নামে অধিগ্রহণ করে নামজারি হওয়া ১৯টি দাগের সমন্বয়ে গঠন হয় এসব সম্পত্তি। স্থানীয়রা বলছেন, এসব জমির একাধিক দাগ নিয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা হয়েছে বেশ কয়েকটি। ফলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার আগে এসব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করারও সুযোগ নেই। 

স্থানীয়রা আরও জানান, ধউর এলাকার এই সম্পত্তিগুলো ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি হিসেবে প্রজাবিলি হয়ে গেছে ১৯৫২ সালের গেজেট অনুযায়ী। অর্থাৎ ভাওয়াল স্টেট থেকে এস এ-তে রেকর্ড হয়ে গেছে। পরবর্তীতে ডিএসএ-তেও রেকর্ড হয়ে গেছে। সুতরাং এগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি। কিন্তু এই জমিগুলো এখন আবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি চক্র ভাওয়াল রাজার জমি ও খাস জমি উল্লেখ করে নতুন করে দলিল করে নেয় গত ১৬ই জানুয়ারি। বাসিন্দারা মনে করছেন, জেলা প্রশাসন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এই দলিল করে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৩শে জানুয়ারি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ধউর মৌজার এই ১৬. ৩৫৮২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে  বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে জমির পরিমাণ উল্লেখ করে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ওই গেজেটে বলা হয়, বর্ণিত সম্পত্তি ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের অনুকূলে ভূমি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সমস্যা সমাধান প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং তদানুযায়ী ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ১৯৮২ (১৯৮২ সনের ২নং অধ্যাদেশ) এর ১০ (২) ধারা অনুসারে এর ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে অথবা ক্ষতিপূরণ করা হবে বলে অনুমিত হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) মো. বদরুদ্দোজা শুভর জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, উক্ত অধ্যাদেশের ১১(২) ধারা অনুযায়ী আমি ঘোষণা করছি যে উক্ত সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে অধিগ্রহণ করা হলো এবং এর সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্বমুক্ত হয়ে সরকারের ওপর অর্পিত হলো।

গত বুধবার তুরাগ থানাধীন ধউর এলাকার ওই জমিগুলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখা হয় সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা আলী হোসেনের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, এখানকার জমিগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশই আমাদের নিজেদের পরিবারের। এ ছাড়া অনেক জমি আছে ধউর এলাকার স্থানীয়দের। তারা নানা সময় এসব জমি কিনেছেন। কেউ কেউ বাবার দেয়া দলিলের ভিত্তিতে ভোগ করছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই শুনি আমাদেরসহ এখানকার যত জমি আছে সবই ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বহুমুখী সমিতির দলিল হয়ে চট জলদি নাম জারি হয়ে গেছে। এটা খুব অবাক লাগলো। ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে এসব জমি আমাদের কেনা। এখন বলা হচ্ছে এগুলো অধিগ্রহণ করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির নামে। এখানে একটি বিষয় আছে, আমাদের এখানে একটা প্লট আছে যেটা নিয়ে আদালতে আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আদালতে অমীমাংসিত বিষয় কীভাবে সমিতির নামে অধিগ্রহণ হয় তাও অবাক করেছে আমাদের।  আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই। 

আলী হোসেন আরও জানান, জমি নিয়ে উচ্চ আদালতে যে রিট দায়ের আছে তার সব ধরনের কাগজপত্র রয়েছে তার কাছে। গত ১৬ই জানুয়ারি লেখা ৫৩১ নং দলিলের কয়েকটি জমি নিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা আছে। এগুলো রায় হয়নি। 
জমির মালিকানা দাবি করা আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শরীফ মানবজমিনকে বলেন, আমি আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে জমি কিনেছি। ছোট করে বাড়িও করেছি এখানে। এখন শুনছি জমির মালিকানা চলে গেছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমিতির নামে। এটা কীভাবে সম্ভব!  আমার জমি অন্য কেউ কীভাবে নিয়ে নেয়? আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনে আদালতে যাবো। এটা সুরাহা হওয়া দরকার। 

শরীফ আরও বলেন, সরকার যদি অধিগ্রহণই করতো তাহলে আগে আমাদের নোটিশ করবে। নোটিশ ছাড়া এসব জমি কীভাবে অধিগ্রহণ করে। আমরা কোনো নোটিশই পাইনি। তাছাড়া ২০১৬ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেটের সিএস রেকর্ড করা সম্পত্তি যা ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালের গেজেট মোতাবেক প্রজাবিলি হয়ে এস এ-তে রেকর্ড হয়েছে তার ব্যবস্থাপনায় আইনি এখতিয়ার না থাকায় এসব সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা করা যাবে না। তাহলে ভূমি মন্ত্রণালয়েরই একটা সমিতি কীভাবে তাদের নামে এটা নামজারি করায়?  

যেভাবে জমি চলে যায় সমিতির নামে
গত ১৬ই জানুয়ারি ১৬ একরের বেশি পরিমাণ জমি দলিল হওয়ার পর ২৩শে জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ হয় ডিসি অফিস থেকে। বিভিন্ন নথিপত্র সূত্র বলছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিগুলো মাত্র এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দলিল করে তা নামজারি হয়ে গেছে। যার পেছনে অদৃশ্য বলয় কাজ করেছে বলে মনে করছেন ধউরের স্থানীয় বাসিন্দারা। মিরপুর রাজস্ব সার্কেলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমিতি মিউটেশনের আবেদন করে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। (আবেদন নং-১১২৮১৮৬৮)। সমিতির পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি হিসেবে আবেদনকারী হিসেবে রয়েছেন মো. জসীম উদ্দিন পাটোয়ারী।  সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান বরাবর আবেদনে বলা হয় নিম্ন তফসিল বর্ণিত ভূমি ‘অধিগ্রহণ’ প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানাধীন জমি’ মালিকানাপ্রাপ্ত হয়ে ভোগদখলে আছি। সে পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত জমি মিউটেশন/জমা খারিজ/জমা একত্রীকরণের জন্য আবেদন করছি। ৯ই ফেব্রুয়ারি এসিল্যান্ড মিজানুর রহমান ওই আবেদন অনুমোদন করে স্বাক্ষর করেন। 

এ বিষয়ে জানতে মিজানুর রহমানকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মুঠোফোনে সাড়া দেননি জমির গ্রহীতার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা ভূমি মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বহুমুখী সমিতির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন পাটোয়ারীও। 
তবে ডিসি অফিস থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. বদরুদ্দোজা শুভর সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। তিনি বলেন, জমিগুলো তো অনেক আগের বিষয়। কোর্ট অব ওয়ার্ডসের জমি। এ বিষয়ে অধিগ্রহণের সময় আমাকে কেউ কোনো আইনি জটিলতার কথা জানাননি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা ডকুমেন্টসও ফাইলে ছিল না। মামলা থাকার বিষয়টিও আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। নিয়ম অনুযায়ীই অধিগ্রহণ হয়েছে।