Image description

চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ৩৬টি খাল ঘিরে বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বরাদ্দে শুরু করা এ প্রকল্পের আকার এখন ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।

৩৬ খালের মধ্যে ১৯টির কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানালেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তবে হিজরা খালে প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। যেখানে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) মায়ের কোল থেকে পড়ে তলিয়ে যায় ছয় মাসের শিশু সেহরিজ। জমি অধিগ্রহণ ও আর্থিক সক্ষমতার অভাবে এ খালের কাজ করা যায়নি বলে জানান প্রকল্পটির পূর্ত কাজ দেখভালকারী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ। হিজরাসহ প্রকল্পের ১৭টি খাল-নালা এখনো বিপদের কারণ হতে পারে। গত সাড়ে তিন বছরে উন্মুক্ত খাল ও নালায় পড়ে প্রাণ গেছে ৬ জনের।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। দীর্ঘদিন উদ্ধার অভিযান চালানো হলেও তাঁর মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা যান। ২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু কামাল। তিন দিন পর মুরাদপুর থেকে উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ায় উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৭ ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার হয় তার মরদেহ। আর ২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পাওয়া যায় তার মরদেহ। সর্বশেষ ঘটনা ঘটে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে। চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে ছিটকে উন্মুক্ত নালায় পড়ে যায় শিশুসহ তিনজন। তাদের মধ্যে দুই নারীকে স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করেন। তাঁরা শিশুটির মা ও দাদি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে থাকা ছয় মাস বয়সী শিশু সেহরিজ পানির স্রোতে তলিয়ে যায়।

খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিস এবং পরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও সিটি করপোরেশনের টিম রাতভর অভিযান পরিচালনা করে। শনিবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আসাদগঞ্জের চামড়া গুদাম মোড়ের পার্শ্ববর্তী চাক্তাই খাল থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

সিডিএর তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের খাল পুনঃখনন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল পুনঃখনন ও সংস্কারে ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে সিডিএ। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা সমস্যায় প্রকল্পটি এখনো শেষ করা যায়নি। এরই মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে সংশোধনের পর প্রকল্প ব্যয় আরও ৩ হাজার ১০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। বর্তমানে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকায় দাঁড়ানো এ প্রকল্পের কাজ আগামী বছর জুন মাসের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে জানান সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস ও প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ।

চট্টগ্রাম নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার পাশ ঘেঁষে যাওয়া রাজাখালী খাল এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, খালটির দুই পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনীর অংশ হিসেবে রিটেইনিং দেয়াল, দেয়ালের এক পাশে ১৫ ফুট রাস্তা, আরেক পাশে ৫ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে চাকতাই খালের ডিসি রোড এলাকায় দেখা গেছে, রিটেইনিং দেয়াল নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেতুর কাজ চলছে। দুই পাশে রাস্তা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিবুল আলম বলেন, ‘আমার বাসার সামনে যে খালটা আছে, সেটি অন্তত দুই বছর ধরে খোলা। বর্ষাকালে পানি উপচে রাস্তায় চলে আসে, তখন আর বোঝা যায় না, কোথায় খাল আর কোথায় রাস্তা। শুক্রবার একটা রিকশা উল্টে মা ও দাদির সঙ্গে এক শিশু নালায় পড়ে যায়। মা ও দাদি উঠে এলেও শিশুটি তলিয়ে গিয়ে মারা যায়। এ ঘটনার পর থেকে ভয়ে আছি। এভাবে কি চলে?’

এ বিষয়ে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের কাছে আমরা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের বলেছিল ৭৫০ কোটি দেবে এবং বাকি ৭৫০ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হবে। কিন্তু আমরা এই টাকা পাব কোথায়? এ জন্য হিজরা খালে আমরা কাজ ধরতে পারিনি। অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এক মাস আগে আমাদের ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখন হিজরা খালে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে এক দিক থেকে ভাঙা শুরু হয়েছে।’