Image description

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের ১ জুলাই শুরু হওয়া আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে শিক্ষার্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম। ৩৬ দিনের (১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পতন হয়। কোটা সংস্কার থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান—পুরো আন্দোলনে অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মো. নাহিদ ইসলাম। পরে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হন। উপদেষ্টার পদ ছেড়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই সমন্বয়ক। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে গত এক বছরের অর্জন, প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নাহিদ ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

 

প্রথম আলো

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। ওই সময়ের এমন কোনো ঘটনার কথা বলবেন কি, যা এখনো প্রকাশ করেননি?

নাহিদ ইসলাম: কোটা সংস্কার আন্দোলন ও গণ–অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী এক বছর—এই পুরো সময়টাই বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল। সব ঘটনা এখনো বলার সময় আসেনি।

জুলাইয়ের আন্দোলন কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, তার পেছনের প্রেক্ষাপট কী—এর ভেতরের অনেক কিছুই সামনে আসেনি। আমরা এখন নানা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতরে থাকায় সেই সুযোগটা হচ্ছে না। যেকোনো বড় ঘটনার পর তার ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য সময় লাগে।

প্রথম আলো

যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান হয়েছিল, গত এক বছরে সেটা কতটা পূরণ হলো?

নাহিদ ইসলাম: জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাটা কী, সেটা আগে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান একেকজনের কাছে একেক রকম।

প্রথম আলো

আপনারা যেভাবে দেখেন, তা–ই বলুন।

নাহিদ ইসলাম: আমাদের কাছে আকাঙ্ক্ষাটা ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার পতন বা বিলোপ ঘটেনি। সেই ব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে। সেই ব্যবস্থার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরে গেছে, আরেকটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের লড়াইটা সেই ব্যবস্থার সঙ্গে। পুরোনো ব্যবস্থাকে ভাঙতে বা পরিবর্তন করতে হবে। সেই জায়গায় আসলে অর্জন হয়নি এখনো। বৈপ্লবিক দায়িত্বটা পালন হয়েছে, কিন্তু গঠনটা আমরা এখনো করতে পারিনি।

অনেকে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেবল সরকার পতনের একটা ঘটনা হিসেবে দেখেন। তাঁদের কাছে তো আওয়ামী লীগের পতনটাই অর্জন বা এখানেই জুলাই শেষ। আমাদের কাছে জুলাই এখান থেকে শুরু আসলে। সেই জায়গায় আমাদের অবশ্যই অপ্রাপ্তি আছে। কিন্তু এই সংগ্রাম বা আকাঙ্ক্ষার জন্য যাত্রাটা চলমান।

গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতার প্রতিরোধ। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকার উত্তরা
গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতার প্রতিরোধ। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকার উত্তরাছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো

আপনি যে অপ্রাপ্তির কথা বলছেন, তার কারণ কী বলে মনে করেন?

নাহিদ ইসলাম: অভ্যুত্থানের সময় প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। আমাদের নেতৃত্বের অনেক ধরনের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম ছিল না। ৫ আগস্টের পর যখন এটাকে সংগঠিত করতে চাওয়া হয়েছে, তখন নানা দিক থেকে বাধা এসেছে। ফলে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যায়নি। শিক্ষার্থীদের সঠিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রাখা যায়নি।

একই সঙ্গে সরকার ও রাজপথে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। সরকারের জায়গা থেকে ক্ষমতার ওপর যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন ছিল, সেটা তারা করতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সরকার বা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে যে ঐক্য বা অঘোষিত–অলিখিত চুক্তিটা হয়েছিল, সেই চুক্তিটা ভঙ্গ হয়েছে, সেখানে অনৈক্য হয়েছে। জুলাইয়ের পরে প্রত্যেকে যার যার এজেন্ডায় চলে গেছে। সবাই রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এজেন্ডায় এক জায়গায় আসতে পারেনি। শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত সবাই এক জায়গায় থাকলেও পরে আর সবাই এক জায়গায় থাকেনি। এর ফলে অনেক কিছু করার যে সুযোগ আমাদের ছিল, সেটা করা যায়নি।

আরেকটা কারণ হলো সেই আমলাতন্ত্র, সেই সেনাবাহিনী, সেই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর অলিগার্করা রয়ে গেছে।

অনেকে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেবল সরকার পতনের একটা ঘটনা হিসেবে দেখেন। তাঁদের কাছে তো আওয়ামী লীগের পতনটাই অর্জন বা এখানেই জুলাই শেষ। আমাদের কাছে জুলাই এখান থেকে শুরু আসলে। সেই জায়গায় আমাদের অবশ্যই অপ্রাপ্তি আছে। কিন্তু এই সংগ্রাম বা আকাঙ্ক্ষার জন্য যাত্রাটা চলমান।
 
প্রথম আলো

এই সরকারের জন্য উদ্বেগের প্রধান দুটি বিষয় হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ‘মব’ (দলবদ্ধ সহিংসতা)। এ বিষয়ে আপনাদের কোনো পর্যবেক্ষণ আছে?

নাহিদ ইসলাম: আমি জানি না এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী রকম। তারা মাঠে থেকে চেষ্টা করছে, তারপরও কেন পুলিশকে আরও সক্রিয় করা গেল না...। পুলিশকে আরও অনেক বেশি সক্রিয় করা সম্ভব হতো যদি শিক্ষার্থীদের আরও বেশি মাঠে রাখা যেত, ব্যবহার করা যেত। ৫ আগস্টের পরে শিক্ষার্থীরাই থানাগুলাকে সক্রিয় করেছিল। নতুন পুলিশ নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবু আইনশৃঙ্খলার অনেকখানি উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই আইনশৃঙ্খলা বা এই পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে আমরা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব কি না, সেটা নিয়ে সংশয় আছে।

‘মব’ বলে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, তার সঙ্গে আমরা একমত নই। যাদের ‘মব’ বলা হচ্ছে, এরা বিক্ষুব্ধ জনগণ। সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে এদের নানাজন নানাভাবে ব্যবহার করেছে, ডাইভার্ট করেছে, নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বা গোষ্ঠী এজেন্ডায় তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এটা আমাদেরও সীমাবদ্ধতা। জনগণকে একটা দিকে ধাবিত করার মতো কর্মসূচি সরকারের দিক থেকেও অনুপস্থিত ছিল।

মানুষ কর্মসূচি চেয়েছে, দেশ গঠনের জন্য কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। দেখা গেছে পুরোনো তর্ক, নানা ধরনের গোষ্ঠীগত স্বার্থের রাজনীতির ভিত্তিতে অভ্যুত্থানকারী বিভিন্ন অংশ নিজেদের মতাদর্শগতভাবে ভাগ করেছে। তাদের এখন ‘মব’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় যেটাকে ‘মব’ বলা হচ্ছে, এটা শুধু পুলিশি বা আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়। এটা আরও বহু বছর বাংলাদেশে থাকবে। কারণ, এরা অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সরকার বা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে যে ঐক্য বা অঘোষিত–অলিখিত চুক্তিটা হয়েছিল, সেই চুক্তিটা ভঙ্গ হয়েছে, সেখানে অনৈক্য হয়েছে।
প্রথম আলো

কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী একটা সরকারের শাসনামলে আইন হাতে তুলে নেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য?

নাহিদ ইসলাম: সরকার নিজে ‘প্রো–অ্যাকটিভ’ না হলে তখনই তারা এই সুযোগটা পায়। অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতাকে যতক্ষণ না একত্র করা যাচ্ছে, সঠিক নেতৃত্ব ও কর্মসূচি দেওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ এই পরিস্থিতি থাকবে। সেটার জন্যই আমরা রাজনৈতিক দল করেছি। কারণ, আমরা মনে করেছি যে এই অভ্যুত্থান যারা করেছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ধারণ করতে পারবে না।

প্রথম আলো

এক বছরেও অভ্যুত্থানের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হলো না। শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিরা নানা অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন সময়ে।

নাহিদ ইসলাম: আমরা মনে করি, সরকারের পক্ষ থেকে যাঁরা তালিকা করেছেন, তাঁদের এ বিষয়টা পরিষ্কার করে ঘোষণা দেওয়া উচিত যে আর তালিকা নেই। নিখোঁজ থাকলে নিখোঁজ। কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে তালিকা করা হচ্ছে, তা উন্মুক্ত করে দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

আর পুনর্বাসনের জন্য সরকার অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন আর্থিক সুবিধা বা বাজেট বরাদ্দ ইতিমধ্যে হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতার কারণে সুযোগ-সুবিধাগুলো তাঁদের হাতে সঠিক সময়ে পৌঁছাচ্ছে না। তবে জুলাইয়ের ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারের আরও ভূমিকা রাখা উচিত।

 
প্রথম আলো

জুলাই অভ্যুত্থানে, বিশেষ করে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের ঐক্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি ভেঙে গেল। অনেক ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধেরও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো এর জন্য মূলত আপনাদের দায়ী করছে।

নাহিদ ইসলাম: ক্ষমতা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে মনে করেন আমরা উপদেষ্টা হতে পেরেছি, তাঁরা হতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, এখন যেভাবে দেখা হয়, আন্দোলনের সময় কিন্তু আমরা এত ছাত্রসংগঠন দেখিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্ল্যাটফর্ম ছিল না।

ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল ও ছাত্রসংগঠন অভ্যুত্থানে ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর সবার এক থাকতে না পারার দায় এককভাবে কারও নয়। তবে আমি মনে করি, জাতির প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে যাতে একসঙ্গে হতে পারি, সেই সম্পর্ক ও যোগাযোগটা অভ্যুত্থানের সব পক্ষের মধ্যে থাকা উচিত।

প্রথম আলো

আপনি এনসিপির দায়িত্ব নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। সামগ্রিকভাবে সরকারের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে বলা হলে ১০–এ কত দেবেন?

নাহিদ ইসলাম: নম্বর দিতে চাই না। এই সরকারের যে রাজনৈতিক সমর্থন দরকার ছিল, সেটা শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা পেয়েছে, অন্য কোনো দলের কাছ থেকে পায়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত ছিল না, হতেও দেওয়া হয়নি। সেনাবাহিনী থেকেও সেই সমর্থন আসেনি। সরকার কোন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কাজগুলো করবে?

ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল ও ছাত্রসংগঠন অভ্যুত্থানে ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর সবার এক থাকতে না পারার দায় এককভাবে কারও নয়। তবে আমি মনে করি, জাতির প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে যাতে একসঙ্গে হতে পারি, সেই সম্পর্ক ও যোগাযোগটা অভ্যুত্থানের সব পক্ষের মধ্যে থাকা উচিত।
প্রথম আলো

জুলাই সনদ হতে যাচ্ছে। কিন্তু আপনাদের দাবি করা জুলাই ঘোষণাপত্র অভ্যুত্থানের এক বছরেও হলো না। এ বিষয়ে আপনাদের কোনো চিন্তা আছে?

নাহিদ ইসলাম: দুই দফায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারল না। কেন দিতে পারল না, সেটাও স্পষ্ট করল না। এখন আমরা আর সরকারের কাছ থেকে এটা আশাও করি না। অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে যারা যারা আসবে, তাদের নিয়েই আমরা নিজেরাই ঘোষণাপত্র দেব। আগামী ৫ আগস্টের মধ্যেই এটা হবে।

প্রথম আলো

অভ্যুত্থানের পর থেকে সমন্বয়ক পরিচয়ে নানা অপকর্মের অভিযোগ সামনে এসেছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকে এবং সমন্বয়কদের ঘনিষ্ঠ অনেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এগুলো কি জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী নয়?

নাহিদ ইসলাম: শুরুর দিকে দুর্নীতি ছিল না। কিছুদিন পরে মাঝের স্তর থেকে আবার দুর্নীতি শুরু হয়েছে। ছাত্রদের একটা অংশ যে নানাভাবে এর সঙ্গে জড়িয়েছে, এটাও আমরা স্বীকার করি। আগের যে ব্যবস্থা, সেটা কিন্তু বহাল ছিল। আগের লোকেরা যখনই একটু সুযোগ পেয়েছে, আগের নিয়মকানুন চালু করেছে। ছাত্রদের একটা অংশকে তারা এর সঙ্গে যুক্ত করেছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের অনেকেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় ব্যবহার করে এসব কাজে যুক্ত হয়েছে।

কিন্তু যা ঘটেছে, তার চেয়ে অপপ্রচার বেশি হয়েছে। এটা পরিকল্পিত ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে চিত্রিত করে শিক্ষার্থীদের নৈতিক ভিত্তি নষ্ট করে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া। ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেকখানি অন্যায্য আচরণ হয়েছে।

প্রথম আলো

আপনারা একটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে এই দল গঠনের আগে কী আশা করেছিলেন আর দল গঠনের পর মাঠপর্যায়ে গিয়ে কী মনে হচ্ছে?

নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ, আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমাদের নিজেদের পারফরম্যান্সে হয়তো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ চাইছে আমরা তাদের কাছে গিয়ে কথা বলি, আমাদের রাজনীতিটা স্পষ্ট করি। কিন্তু আমরা নানা জটিলতায় তাদের কাছে যেতে পারছি না। সার্বিকভাবে আমি বলব, মানুষের জায়গা থেকে সাড়া আছে, আমাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে।

নাহিদ ইসলাম
নাহিদ ইসলামফাইল ছবি
প্রথম আলো

কেউ কেউ একটি ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে আপনাদের বিশেষ সম্পর্কের বিষয়ে অভিযোগ করে থাকেন। এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান?

নাহিদ ইসলাম: এটা খুবই দুঃখজনক। আওয়ামী লীগের সময়ে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছি, তখনো আমাদের এই ‘ট্যাগ’ দেওয়া হয়েছে। এখনো করা হচ্ছে। এনসিপি মধ্যমপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়। একাত্তর, ইসলাম, নারী ইত্যাদি বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি।

আমি মনে করি, এখানে হয়তো যোগাযোগের একটা ঘাটতি আছে। এ ছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপপ্রচারও আছে।

আমরা হয়তো নিজেদের রাজনীতি বা আদর্শ স্পষ্ট করতে পারছি না। আবার ছাত্ররা কী চায়, সেটা বোঝার আগ্রহও অনেকের মধ্যে দেখা যায় না। কিছু বদ্ধমূল ধারণা বা পুরোনো ছকে অনেকে দেখার চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের ফ্রেমিং থেকে দেখা থেকে উচিত নয়।

একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুশীল সমাজ এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়নি। যদিও তাদের অনেকের অংশগ্রহণ ছিল। সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটতে সহায়তা করেছে। গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতার মাধ্যমে। আমরা তাঁদের কাছে নিজেদের রাজনীতি স্পষ্ট করতে চাই।

আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমাদের নিজেদের পারফরম্যান্সে হয়তো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ চাইছে আমরা তাদের কাছে গিয়ে কথা বলি, আমাদের রাজনীতিটা স্পষ্ট করি। কিন্তু আমরা নানা জটিলতায় তাদের কাছে যেতে পারছি না। সার্বিকভাবে আমি বলব, মানুষের জায়গা থেকে সাড়া আছে, আমাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে।
 
প্রথম আলো

আপনাদের নেতাদের বক্তব্যে বিএনপির সমালোচনা দেখা যায়। এটা কি আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো মেরুকরণের ইঙ্গিত?

নাহিদ ইসলাম: আমরা কোনো দলের বিরুদ্ধে বা পক্ষে—বিষয়টা এমন নয়। আমরা পুরোনো বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। বিএনপি এই বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। তারা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এখন বিএনপি বা যেকোনো দল যদি পুরোনো বন্দোবস্তকে রক্ষা করতে চায় বা আওয়ামী লীগের জায়গায় পুনঃস্থাপিত হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে নতুন আওয়ামী লীগ হিসেবে দেখা হবে। বিএনপি তার রাজনীতি স্পষ্ট করেনি। নতুন রাজনীতির জন্য নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরের গণহত্যা–সম্পর্কিত যে অভিযোগ আছে, তারাও সে বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। সেই জায়গা থেকে পুরোনো রেটোরিক বা পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি আবার ফেরত আসছে।

 
প্রথম আলো

একজন নারীর সঙ্গে আপনাদের একজন নেতার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া অডিও নিয়ে নানা আলোচনা দেখা গেল। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

নাহিদ ইসলাম: যেকোনো ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে রাজনৈতিকভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটা ঘটনা ঘটেছে। আমরা একটা ব্যবস্থা নিয়েছি, সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে। কিন্তু যে প্রচারণাটা হয়েছে, সেটা পরিকল্পিত ছিল। অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেত্রীদেরও চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন দলের লোকজন এনসিপির নেত্রীদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালিয়েছেন, তখন আমরা কাউকে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করতে দেখিনি।

গণ–অভ্যুত্থানের একটা প্রধান নৈতিক শক্তি ছিল নারীরা। তাই নারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো আছে।

একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুশীল সমাজ এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়নি। যদিও তাদের অনেকের অংশগ্রহণ ছিল। সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটতে সহায়তা করেছে। গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতার মাধ্যমে। আমরা তাঁদের কাছে নিজেদের রাজনীতি স্পষ্ট করতে চাই।
প্রথম আলো

আগামী নির্বাচনে আপনারা কোনো জোট বা সমঝোতায় যাবেন, নাকি এককভাবেই নির্বাচন করবেন?

নাহিদ ইসলাম: জোট করা বা আসন সমঝোতা—এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। সম্প্রতি আমরা নিবন্ধনের আবেদন করেছি। নির্বাচন বিষয়ে আমরা ভাবব ৫ আগস্টের পরে। এর মধ্যে যদি জুলাই সনদ হয়ে যায়, এটা আমাদের একটা বড় অর্জন হবে। সংস্কারের ধাপটা কিছুটা এগোবে। তারপর আমরা নির্বাচন নিয়ে এগোব।

জোটের বিষয়েও আমরা এখন পর্যন্ত ভাবিনি। আমরা আগে সংগঠনটা তৈরি করতে চাই। এনসিপি এককভাবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে চায়। ফলে নির্বাচন বিষয়ে আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব, এটা এখনই বলা মুশকিল।

তবে যদি জোট করার সম্ভাবনা তৈরি হয়, আদর্শিক মিল থাকলে সেটি হতে পারে। যেসব দলের সঙ্গে আদর্শিক মিল দেখি, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। সংস্কার প্রশ্নে কোন দল কী ভূমিকা রাখে, সেটাও আমরা বিবেচনায় রাখছি।

আমরা কোনো দলের বিরুদ্ধে বা পক্ষে—বিষয়টা এমন নয়। আমরা পুরোনো বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। বিএনপি এই বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। তারা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এখন বিএনপি বা যেকোনো দল যদি পুরোনো বন্দোবস্তকে রক্ষা করতে চায় বা আওয়ামী লীগের জায়গায় পুনঃস্থাপিত হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে নতুন আওয়ামী লীগ হিসেবে দেখা হবে।
প্রথম আলো

অনেকে অভিযোগ করেন, ছাত্র উপদেষ্টারা বাংলো, গাড়ি ইত্যাদি সরকারি সুবিধা নিয়ে পুরোনো বন্দোবস্তে ঢুকে গেছেন। আপনি কী বলবেন?

নাহিদ ইসলাম: আমাদের পুরোনো বন্দোবস্তে ঢোকানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। এখনো সেই চেষ্টা আছে। অনেকে চাইছে আমরা পুরোনো রাজনৈতিক ধারায় আসন ভাগাভাগি, সমঝোতা ইত্যাদির মাধ্যমে আপস করি। কিন্তু আমরা সেটা করছি না। এ কারণে ছাত্রদের প্রতি ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি।

সরকারি পদে থেকে ছাত্র উপদেষ্টারা কোনো অন্যায্য সুবিধা নেননি। আমি উপদেষ্টার দায়িত্ব ছাড়ার পর নিজের ব্যাংক স্টেটমেন্ট থেকে শুরু করে সম্পত্তির তথ্য প্রকাশ করেছি। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একটা বিদেশ সফরও করিনি, প্রয়োজনীয় সফরেও যাইনি। ফলে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা আমরা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিইনি।

প্রথম আলো

আপনারা শুরু থেকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে এসেছেন। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে সেই বন্দোবস্ত আদৌ অর্জিত হবে বলে মনে করেন?

নাহিদ ইসলাম: নতুন বন্দোবস্ত অর্জিত হতেই হবে, তা না হলে গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। নতুন বন্দোবস্ত না হলে আওয়ামী লীগের পতন করে কী লাভ হলো, যদি আরেকটা আওয়ামী লীগই আসে?

প্রথম আলো

আপনাকে ধন্যবাদ।

নাহিদ ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।