মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সবার মনেই একটি প্রশ্ন–আসন্ন নির্বাচনের পর দেশটির সামনে কী অপেক্ষা করছে?
যদি আপনি মিয়ানমারের আধ্যাত্মিক ভবিষ্যৎবাণী প্রদানকারীদের বিশ্বাস করেন, সেক্ষেত্রে উত্তরটি লুকিয়ে আছে আকাশে সারিবদ্ধ তারা, কালো জাদুর মোমবাতির শিখা আর জ্যামিতিক মাপজোকের আড়ালে, যা কিনা কেবল তৃতীয় নয়নেই ধরা পড়বে।
এ বিষয়ে জোতির্বিদ লিন নায়ো তারইয়ার বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষের মনেই একটি প্রশ্ন রয়েছে বেশ পরিষ্কাভাবে, আর তা হলো মিয়ানমার কবে সমৃদ্ধির পথে যাবে?’
পাঁচ বছর আগেও মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ ছিল নিশ্চিত পথে। দীর্ঘদিনে সামরিক শাসনের পর দেশটি এক দশকের গণতান্ত্রিক পরীক্ষার স্বাদ উপভোগ করছিল। কিন্তু ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান সে সময়কার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, যার ফলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ এবং চরম অনিশ্চয়তা।
আগামী ২৮ ডিসেম্বর আরেকটি অনিশ্চয়তায় পড়তে যাচ্ছে দেশটি। এর কারণ ধাপে ধাপে নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে সেখানে। বিদ্রোহীরা এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিদেশে এটিকে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের নতুন রূপ দেওয়ার ‘চাল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, সমালোচনা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের ভাগ্য গণনা
মিয়ানমারে ভাগ্য গণনার এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে এবং অনেকেই বিশ্বাস করেন যে আধ্যাত্মিক সাধকদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানা সম্ভব। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনের ফলাফল এমনকি ‘ইয়াদায়ার’ মাধ্যমেও প্রভাবিত হতে পারে। ইয়াদায়া সেখানে ভাগ্য পরিবর্তনের এক তান্ত্রিক আচার হিসেবে পরিচিত।
৩০ বছর বয়সী লিন নিও টারইয়ার এ বিষয়ে এএফপিকে বলেন, সংকটে পড়া মানুষ ভাগ্য গণনা এবং ইয়াদায়ার ওপর ভরসা করে, সেখান থেকে শক্তি ও বিশ্বাস খোঁজার চেষ্টা করে। মানুষ আসলে একটি নিরাপদ ও নিশ্চিত জীবন এবং ভবিষ্যৎ চায়।
তবে, লিন নিও টারইয়ারের এই ভবিষ্যৎবাণী দেওয়ার পেশা মোটেও নিরাপদ ছিল না। অভ্যুত্থানের পর যখন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে—যা তিনি আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন বলে দাবি করেন—তখন তিনি সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ওপর ‘নয়টি তলোয়ার, নয়টি সূঁচ’ নামক একটি অভিশাপমূলক তান্ত্রিক ক্রিয়া প্রয়োগ করেন। সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি অন্য সাধকদেরও একই কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ছুরি বা তলোয়ারের ওপর তারার আকারে মোমবাতি সাজিয়ে করা এই আচারের কারণে তাকে ইয়াঙ্গুনের কুখ্যাত ইনসেইন কারাগারে দুই বছর কাটাতে হয়। তার বিরুদ্ধে ভীতি বা আতঙ্ক সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্তির পর বর্তমানে তিনি ব্যাংককে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন এবং অনলাইনে মিয়ানমারের মক্কেলদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
মিয়ানমারের সংস্কৃতি বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত। জ্যোতিষীরা জাতীয় রাশিচক্র পর্যবেক্ষণ করেন, হাতুড়ে গণকরা প্যাগোডার চারপাশে ভিড় জমান, কেউ কেউ পারদকে সোনায় রূপান্তরের চেষ্টা করেন, এমনকি সিম কার্ড কোম্পানিগুলোও ফোনে জ্যোতিষী সেবার বিজ্ঞাপন দেয়।

অতীতের দুঃস্বপ্ন
মিয়ানমারের মরমী সাধকদের নিয়ে গবেষণা করা নিউইয়র্কের ইউনিয়ন কলেজের অধ্যাপক থমাস প্যাটান বলেন, ‘তারা সব ধরনের সমস্যার সমাধান দেন। মিয়ানমারে এটি উন্নয়নের প্রভাব না থাকার লক্ষণ। মানুষের আর কোনো বিকল্প নেই। যখন চারপাশে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা থাকে, তখন এই হাজার বছরের পুরনো মন্ত্র, ওষুধ এবং গোপন জ্ঞান বার্মিজদের চেতনায় মিশে যায়।’
রহস্যময় এই বিশ্বাস রাজনীতির অন্দরমহলেও প্রভাব বিস্তার করে আছে। সাবেক সামরিক শাসক নে উইন রাস্তার নিয়ম পরিবর্তন করে যানবাহন চলাচলের লেন অদলবদল করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তার বামপন্থি শাসনব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থি দিকে মোড় দেওয়ার জন্য এক জ্যোতিষীর পরামর্শের ভুল ব্যাখ্যা থেকে তিনি এটি করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে সংখ্যাতত্ত্বের ভক্ত এই শাসক নয় (৯) সংখ্যার নোট চালু করেছিলেন—যা শুভ মনে করা হলেও সাধারণ মানুষকে মানসিক পাটিগণিত করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল।
গণবিক্ষোভের মুখে নে উইন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেও মিয়ানমারের সামরিক কমান্ড এখন মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে, যার সম্পর্কেও গুজব রয়েছে যে তিনি কুসংস্কার দিয়ে পরিচালিত। ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চি বর্তমানে কারাগারে এবং তার দল বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মাসব্যাপী এই নির্বাচন মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনকে একটি ‘বেসামরিক’ রূপ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী করবে।
২০২৬ সালের শুরুর দিকে শুরু হতে যাওয়া বৌদ্ধ নববর্ষের জন্য মিয়ানমারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাশিফলগুলোতে পরস্পরবিরোধী পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। মিয়ানমার ক্যালেন্ডার অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সদস্যরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, মঙ্গলবার জন্ম নেওয়া সিংহ রাশির জাতকরা (যাদের মধ্যে মিন অং হ্লাইং এবং সু চি উভয়ই রয়েছেন) যত বেশি বাধার সম্মুখীন হবেন, ততই সফল হবেন।

এতে আরও বলা হয়, তারা যেখানেই থাকুন না কেন ভালো থাকবেন এবং বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাবেন। ইয়াদায়া পালনকারীদের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বুদ্ধ মূর্তির বেদীতে ঘি-ভাত নিবেদন করার জন্য।
আধ্যাত্মিক সতর্কতা
ইয়াঙ্গুনে ৭৩ বছর বয়সী মিন থেইন কিয়াও তাস দেখে ভাগ্য গণনা করেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, আগামী বছরে মিয়ানমারের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যেকোনো ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরি সফল হতে তিনটি বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন–সময়, স্থান ও ব্যক্তি।
উত্তাল মিয়ানমারে ভবিষ্যৎদ্রষ্টারাও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। মিন থেইন কিয়াও বলেন, ‘অনেক কিছুর ওপর নজর রাখা প্রয়োজন। সতর্কতাই আসল চাবিকাঠি। যেমন প্রতিটি ব্যক্তির সচেতনতা, নৈতিকতা এবং প্রজ্ঞা থাকা প্রয়োজন—তেমনি ক্ষমতাবানদেরও এই গুণগুলো থাকা উচিত।’