Image description
 

মাথার এক পাশে ভেদ করে ছিল গুলি, অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো বাঁচবে না, চিকিৎসকদের কাছে মনে হয়েছিল এ এক অসম্ভব পরিস্থিতি। তবুও বেঁচে গেছেন মালালা ইউসুফজাই।

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর। স্কুল থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায় বাসে স্কুলে যাওয়ার পথে এক বন্দুকধারীর হামলার শিকার হন মালালা। মাথায় গুলি লাগে মালালার। গুলিটি ঢুকে কানের পাশ দিয়ে মস্তিষ্কের কাছাকাছি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রাথমিক অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়েই সংশয় ছিল।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মালালার অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। নিউরোসার্জন কর্নেল জুনায়েদ খান তাকে পরীক্ষা করে দেখেন, অবস্থা অস্থিতিশীল। চার ঘণ্টা পর মস্তিষ্কে ফোলা বেড়ে গেলে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এসময় জরুরি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন নিউরোসার্জন। কিন্তু মালালার পরিবার প্রথমে রাজি হয়নি। বয়স কম থাকায় জুনায়েদ খানের ওপর তারা ভরসা করতে পারছিলেন না।

পরবর্তীতে জুনায়েদ খান মালালার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, অস্ত্রোপচার না হলে সে মারা যেতে পারে কিংবা কথা বলার ক্ষমতা হারাতে পারে অথবা ডান হাত-পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতের পর মালালার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। অস্ত্রোপচার করে খুলির একটি অংশ সরানো হয়, মস্তিষ্ক থেকে রক্ত জমা সরানো হয় এবং তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। এই অস্ত্রোপচার মস্তিষ্কের চাপ কমিয়ে প্রাথমিকভাবে তার জীবন বাঁচায়।

কিন্তু পরের দিন আবার ইনফেকশন দেখা যায় এর পাশাপাশি অরগানগুলো কার্যকারিতাও বন্ধ দেখা দেয়। মালালাকে তখন ‘মেডিক্যালি ইন্ডিউসড কোমা’য় রাখা হয় এবং তার বেঁচে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এমন সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ বিদেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন।

ইংল্যান্ডের নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ জাভিদ কায়ানি এবং ফিওনা রেনল্ডস সৌভাগ্যবশত ওই সময় পাকিস্তানেই ছিলেন। তারাও মালালার চিকিৎসায় যোগ দেন। তাদের জানান, নিউরোসার্জন জুনায়েদ খানের সময়মতো অস্ত্রোপাচার না করলে মালালাকে হয়তো আর বাঁচানো যেতো না।

পরে মালালাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যুক্তরাজ্যের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালটিতে ব্রিটিশ সৈন্যদের চিকিৎসা ও ট্রমা কেয়ারের জন্য বিশ্বখ্যাত। সেখানেই শুরু হয় তার দীর্ঘ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অধ্যায়।

বার্মিংহামে পরীক্ষায় দেখা যায়, মালালার কোনো মেজর নিউরোলজিক্যাল ড্যামেজ হয়নি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি ধাপে তার চিকিৎসা সম্পন্ন হয় মালালার।

মালার মুখের পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচার করা হয়। বুলেট তার মুখের হাড় ও স্নায়ুতে যে ক্ষতি করেছিল, তা সারিয়ে তুলতে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা হয়। গুলির আঘাতে তার কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছিল, যা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। এছাড়াও টাইটেনিয়াম প্লেট স্থাপন করা হয় মাথায়। তার খোলা মাথার খুলির অংশটির পরিবর্তে একটি কাস্টম-মেড (আলাদাভাবে তৈরি) টাইটানিয়াম প্লেট স্থাপন করে তার মাথা পুনর্গঠন করা হয়।

প্রথমে ট্র্যাকিওটমির কারণে কথা বলতে পারেননি, কিন্তু কাগজে লিখে যোগাযোগ করেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং তিনি তার পরিবারের সঙ্গে অস্থায়ী বাসায় রিহ্যাবিলিটেশন চালিয়ে যান।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইডেনের বিশ্ব শিশু পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় মালালাকে। একই বছরের মে মাসে হ্যালিফ্যাক্সে ইউনিভার্সিটি অব কিং'স কলেজ তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করে। আর এই বছরের শেষের দিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে যুগ্মভাবে মালালার নাম ঘোষণা করা হয়। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব।