পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনে একটি সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর সেটি ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রেসিডেন্টের অনুগত আরেক দল সৈন্য। এরপর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এসে 'পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে' আছে জানিয়ে প্রেসিডেন্ট প্যাট্টিস টালন দেশের নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছেন।
"আমি আমাদের সেনাবাহিনী ও এর নেতৃত্বের প্রশংসা করতে চাই, যারা দায়িত্ববোধ ও জাতির প্রতি অনুগত থেকেছেন," প্যাট্টিস টালন বলছিলেন। টেলিভিশনে তার বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারের সময় তাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছিলো।
সরকার জানিয়েছে সৈন্যদের একটি দল ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা ওই বিদ্রোহ নস্যাৎ করে দিয়েছে।
পরে দুপুরের দিকে বেনিনের সবচেয়ে বড় শহর কোটোনুতে বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিমান হামলার কারণে এটি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, বিস্ফোরণের আগে প্রতিবেশী নাইজেরিয়া থেকে তিনটি বিমান বেনিনের আকাশসীমায় প্রবেশ করে ও পরে আবার ফিরে যায়।
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের একজন মুখপাত্র পরে নিশ্চিত করেছেন যে, ক্যু বা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের জাতীয় টেলিভিশন ও একটি সামরিক ক্যাম্প থেকে সরিয়ে দিতে সহায়তার জন্য তাদের যুদ্ধ বিমান বেনিনের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিলো।
রবিবার বেনিনে অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার আগেও পশ্চিম আফ্রিকায় একের পর অভ্যুত্থান হয়েছে, যা ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
বেনিন একসময় ফরাসি কলোনি ছিলো। দেশটি এখন আফ্রিকার সবচেয়ে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের দেশগুলোর একটি।
তবে প্রেসিডেন্ট টালনের বিরুদ্ধে তার নীতির সমালোচকদের দমনের অভিযোগ উঠেছে।
দেশটি আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে অন্যতম বড় তুলা উৎপাদক দেশ। যদিও এটি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি।
ছবির উৎস,Reuters
বেনিনের পূর্ব দিকের বড় প্রতিবেশী হলো নাইজেরিয়ো। তারা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে 'গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত' হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বেনিনের ৬৭ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, অনুগত সৈন্যরা বিদ্রোহীদের শেষ ঘাঁটিও উৎপাটন করেছে।
"এই অঙ্গীকারই সুযোগসন্ধানীদের পরাজিত ও দেশটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হবেই," বলেছেন তিনি।
"আমি আবারো আশ্বস্ত করতে চাই যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং সেজন্য আপনাদের শান্তিপূর্ণভাবে কাজে ফিরে যাবার আহবান জানাচ্ছি"।
এই ঘটনা কোনো হতাহত হয়েছে কি-না তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে প্রেসিডেন্ট এই ঘটনার ভিকটিম এবং যারা এখনো বিদ্রোহীদের হাতে আটক আছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
এর আগে সরকারের মুখপাত্র উইলফ্রাইড লিয়ান্দ্রে হাউংবেডজি রয়টার্সকে বলেছেন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
বেনিনের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে বলেছেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১২ জন সরকারি টিভি স্টেশন তছনছ করেছিলেন। এর মধ্যে আগেই বরখাস্ত হওয়া একজন সৈন্যও রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে জানিয়েছে যে, তারা রবিবার সকালে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের কাছে গুলির শব্দ শুনেছেন। এর মধ্যে একদল সৈন্য টেলিভিশনে গিয়ে সংবিধান স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ওই টিভিতে কাজ করছিলেন এমন কয়েকজন সাংবাদিককেও ওই সময় কয়েক ঘণ্টার জন্য জিম্মি করা হয়।
ফরাসি ও রুশ দূতাবাস তাদের নাগরিকদের ঘরেই থাকার অনুরোধ করেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস প্রেসিডেন্সিয়াল কম্পাউন্ডের আশেপাশে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
ছবির উৎস,Getty Images
ওদিকে লেঃ কর্নেল প্যাসকেল টিগরির নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেছে। তাদের অভিযোগ 'উত্তর বেনিনে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতি' প্রেসিডেন্ট যেভাবে মোকাবেলা করছেন তা নিয়ে।
উত্তর সীমান্তে বিদ্রোহ আক্রান্ত নাইজার ও বুরকিনা ফাসোর কাছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেনিনের সেনাবাহিনী ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদার সাথে যোগসূত্র থাকা জিহাদি জঙ্গিরা অগ্রসর হচ্ছে।
বিদ্রোহী সেনাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে "আমাদের নিহত ভাইদের বিষয়ে ও পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহেলা, তাদের পরিবারগুলোর প্রতি অবহেলা করা হয়েছে। মি. প্যাট্টিস টালনের নীতির কারণে তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে"।
বিদ্রোহীরা স্বাস্থ্যসেবায় কাটছাঁট করা, কিডনি ডায়ালাইসিসে সরকারি বরাদ্দ বাতিল ও কর বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম সংকুচিত করার তীব্র সমালোচনা করেছে।
প্রেসিডেন্ট টালন পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে আগামী বছর তার বিদায় নেয়ার কথা। দেশটিতে এপ্রিলে নতুন নির্বাচন হবে।
'কিং অব কটন' হিসেবে পরিচিত এই ব্যবসায়ী প্রথম ক্ষমতায় আসেন ২০১৬ সালে। তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য লড়বেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন। তিনি অর্থমন্ত্রী রমুয়াল্ড ওয়াডাগনিকে তার উত্তরসূরি মনোনীত করেছেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মি. টালনকে তার সমর্থকরা প্রশংসা করেন। তবে বিরোধী মত দমনের জন্য তিনি সমালোচিত।
ছবির উৎস,Getty Images
অক্টোবরে দেশটির নির্বাচন কমিশন বিরোধী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। গত মাসে সংবিধানের একটি সংশোধনী করে পার্লামেন্টে সেনেটের বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
নির্বাচিতদের মেয়াদ পাঁচ থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ দুই মেয়াদেই সীমিত রাখা হয়েছে।
বেনিনে রবিবারের অভ্যুত্থান চেষ্টার কয়েক সপ্তাহ আগেই গিনি বিসাউর প্রেসিডেন্ট উমারো সিসসকো এমবালো উৎখাত হয়েছেন। যদিও আঞ্চলিক অনেক নেতা এটিকে সাজানো ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে যা ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এসব দেশের সাথে রাশিয়া তার সম্পর্ক জোরদার করছে। বুরকিনা ফাসো, মালি ও নাইজার পশ্চিমা আফ্রিকান জোট ত্যাগ করে নিজেরা সাহেল রাষ্ট্রসমূহের জোট গঠন করেছে।
বিবিসি মনিটর বলছে, বেনিনে অভ্যুত্থান চেষ্টা রাশিয়াপন্থী সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রশংসা পাচ্ছে।
আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) অভ্যুত্থান চেষ্টার নিন্দা করেছে। এইউ কমিশন চেয়ারম্যান মাহমৌদ আলী ইউসৌফ যে কোনো অসাংবিধানিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন।