Image description
দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার সমীকরণ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা- সার্ক’ দীর্ঘদিন অচল। দুই প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতাও তুঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রমেই এই অঞ্চলে প্রভাব বাড়াচ্ছে আরেক শক্তিধর রাষ্ট্র চীন। এমন সময় পাকিস্তান সামনে এনেছে ভারতকে বাদ দিয়ে নতুন আঞ্চলিক জোটের ধারণা; যেখানে যুক্ত আছে বাংলাদেশও।

 

প্রশ্ন হলো, এই প্রস্তাব কি কেবল কূটনীতির আরেকটি বার্তা, নাকি সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন শক্তির বলয় তৈরির শুরু? ভারত-পাকিস্তান ছাড়া সার্ক-এর অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যেমন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তান কি নতুন এই আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হবে? কোন দেশ কী ভাবছে, আর এখন কেন এমন উদ্যোগ— চলুন অনুসন্ধান করা যাক আজকের স্ট্রিম এক্সপ্লেইনারে।

 

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা কাঠামো ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) ইসলামাবাদে এক সম্মেলনে তিনি বলেন, তাদের অবস্থান সবসময় প্রতিযোগিতা নয় বরং সহযোগিতার পক্ষে।

 

এই প্রস্তাব মূলত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভারতের বাইরে একটি বিকল্প আঞ্চলিক জোট তৈরির ধারণা তুলে ধরছে। কারণ বহু বছর ধরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে সার্ক প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। জুন মাসে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেয়, যেখানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়গুলো আলোচিত হয়। তারা বলেছিল যে এই আলোচনা ‘কোনও তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে নয়’।

 

দারের মন্তব্য এমন সময়ে এসেছে যখন দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা আরও বেড়েছে। দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান গত মে মাসে মাত্র চার দিনের একটি আকাশযুদ্ধে জড়ায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে। তিনি গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত আশ্রয় নেন এবং বাংলাদেশ তাকে ফেরত চাইলেও নয়াদিল্লি ফিরিয়ে দেয়নি। পরে গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

 

পাকিস্তানের পরিকল্পনা কী?

 

ইসহাক দার বলেন, বাংলাদেশ ও চীনকে নিয়ে শুরু হওয়া ত্রিপক্ষীয় কাঠামোটি পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে গঠিত। তার মতে, এই মডেলকে আরও দেশ বা অঞ্চল যুক্ত করে বড় করা যেতে পারে। তিনি বলেন, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সংযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃথক কাঠামোর মতো গ্রুপ তৈরি হতে পারে। বক্তব্যে তিনি ইঙ্গিত দেন যে আঞ্চলিক উন্নয়ন কারও ‘কঠোর অবস্থানের জিম্মি’ হওয়া উচিত নয়। এ কথায় তিনি ভারতের অবস্থানকে ইঙ্গিত করেন।

 

তাঁর মতে, ভারত-পাকিস্তান সংলাপ ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও ভারতের সঙ্গে সময় সময় উত্থান-পতনের সম্পর্কের অভিজ্ঞতা পেয়েছে। পাকিস্তান এমন দক্ষিণ এশিয়া দেখতে চায় যেখানে বিভাজনের বদলে সহযোগিতা থাকবে, অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক হবে, বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে এবং মর্যাদার ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তি বজায় থাকবে।

 

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের এই প্রস্তাব এখনো ভাবনার স্তরে রয়েছে। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ-এর পরিচালক রাবিয়া আখতার আল-জাজিরাকে বলেন, এই উদ্যোগে এখন ‘বাস্তবায়নের চেয়ে অভিপ্রায়ের প্রতিফলন বেশি’। তবে এতে প্রমাণ হয়, পাকিস্তান সার্ক অচল অবস্থায় থাকায় নতুন আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামো নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

 

সার্ক কী?

 

সার্ক বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনে। শুরুতে সাতটি দেশ সদস্য ছিল—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। পরে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান যুক্ত হয়ে সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় আট।

 

সংস্থাটির ওয়েবসাইট অনুসারে, সার্ক-এর উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, তাদের জীবনমান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি দ্রুততর করা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সাধন করা।

 

তবে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও গত চার দশকে সার্ক কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বৈরিতা। দুই দেশ স্বাধীনতার পর তিনটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করেছে এবং এই বৈরিতা সংগঠনের কার্যক্রম বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।

 

২০১৬ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত অংশগ্রহণ থেকে সরে দাঁড়ায় এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। ফলে সম্মেলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

 

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রাবিয়া আখতার বলেন, সার্ক কাজ করতে হলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বসম্মতি প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় দুই সদস্য ভারত ও পাকিস্তান যদি আঞ্চলিক স্বার্থকে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ থেকে আলাদা না করে, তাহলে সার্ক এগোতে পারবে না।

 

সংস্থাটির শেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে সার্ক প্রায় নিষ্ক্রিয় হলেও এটি এখনও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা বহন করে—যদি ভারত ও পাকিস্তান সহযোগিতার জায়গা তৈরি করতে সম্মত হয়।

 

সার্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ?

 

২০২৫ সালের হিসেবে সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২০০ কোটিরও বেশি। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। তবুও এ অঞ্চলের দেশগুলোর পারস্পরিক বাণিজ্য অত্যন্ত কম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, যার পরিমাণ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। তুলনায়, ১১ দেশ নিয়ে গঠিত আসিয়ান ব্লকের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য তাদের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২৫ শতাংশ, যদিও জনসংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার এক-তৃতীয়াংশেরও কম।

 

বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমানো গেলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় করতে পারত—যা বর্তমানে হওয়া বাণিজ্যের প্রায় তিনগুণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার একটি হলো ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী সময়ে তা আরও কমে ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, সরাসরি বাণিজ্য কম হলেও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য কম হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সংযোগের অভাব। ২০১৪ সালে সার্ক মোটরযান সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, যা হলে ইউরোপের মতো সারা দক্ষিণ এশিয়ায় গাড়ি ও ট্রাক চলাচল সম্ভব হতো। কিন্তু পাকিস্তান ভারতকে কেন্দ্র করে বিরোধের কারণে এ চুক্তি এবং পৃথক রেল যোগাযোগ চুক্তিকেও বাধা দেয়। সেই থেকে সার্ক-এর সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। কেবল মহামারির সময় সদস্য রাষ্ট্রগুলো জরুরি তহবিল গঠন করে এবং স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়—এটিই সাম্প্রতিক কালে উল্লেখযোগ্য যৌথ পদক্ষেপ।

 

দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ফারওয়া আমের বলেন, ভারত ও পাকিস্তান যদি আঞ্চলিক স্বার্থে সীমিত আকারেও সহযোগিতার পথ খুঁজে পায়, তবে সার্ক পুনরায় সক্রিয় হতে পারে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন অগ্রগতি খুব নিকট ভবিষ্যতে সম্ভাবনা কম বলে তিনি মনে করেন।

 

এসব চ্যালেঞ্জের কারণে বহু দেশ সার্ক ছাড়াও বিকল্প আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়তে উদ্যোগী হয়েছে। সার্ক পরিবহন চুক্তি আটকে গেলে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল বিবিআইএন নামে পৃথক সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করে। ভারত বিমসটেক নামে আরেকটি আঞ্চলিক জোটেরও সদস্য। এতে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড রয়েছে।

 

ফারওয়া আমেরের মতে, নিকট ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতাই বেশি গুরুত্ব পাবে। কারণ কম দেশের সঙ্গে সমন্বয় করা সহজ এবং ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনাও তুলনামূলক বেশি।

 

পাকিস্তানের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
 
এই উদ্যোগ সফল হবে কি না—তা মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন গবেষক আখতার। প্রথমত, সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলো কতটা মনে করে যে বড় আঞ্চলিক কাঠামো কার্যকর না থাকায় ছোট ও নির্দিষ্ট ইস্যুভিত্তিক জোট তাদের জন্য বাস্তব সুফল দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই জোটে যুক্ত হওয়া ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের ঝুঁকি তৈরি করবে কি না—এ বিচারও গুরুত্বপূর্ণ।

 

আখতারের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের এই ধারণায় প্রাথমিক আগ্রহ দেখাতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটে যোগদানের সম্ভাবনা কম। তিনি মনে করেন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এবং সম্ভবত ভুটান এ ধরনের আলোচনায় যুক্ত হতে আগ্রহী হতে পারে—বিশেষ করে সংযোগ, জলবায়ু অভিযোজন এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়ে।

 

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা এবং পাকিস্তান-চীনের তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন সদস্য রাষ্ট্র যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে সম্ভাব্য সদস্য নির্বাচন ও জোট সম্প্রসারণ ধীরে এবং সতর্কতার সঙ্গে এগোবে।

 

অন্যদিকে এএসপিআইর গবেষক আমির মনে করেন, পাকিস্তানের প্রস্তাবটি কৌশলগত দিক থেকে সুসংগঠিত। তাঁর ভাষায়, পাকিস্তান বর্তমানে কূটনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশটি চীনের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করছে।

 

এই দ্বিমাত্রিক কূটনৈতিক অবস্থান পাকিস্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। ফলে দেশটি আঞ্চলিক কূটনীতিতে নিজেকে আবারও প্রভাবশালী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে—অর্থাৎ আঞ্চলিক আলোচনার কেন্দ্রভাগে ফেরার লক্ষ্য রাখছে।

 

অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের অবস্থান কী হতে পারে?

 

পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশ নতুন এই জোটের বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, বাকি রাষ্ট্রগুলো কি যুক্ত হবে?

 

এখানে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা এখন নতুন আঞ্চলিক সমীকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে। ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি এই জোট গঠনের ক্ষেত্রে নতুন ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে বহুপাক্ষিক কূটনীতি এবং এক মেরুতে আটকে না থাকার নীতি অনুসরণ করে। অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং সীমান্ত নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশ সরাসরি ভারত-বহির্ভূত ব্লকে যোগ দেবে কি না; এটি এখনো অনিশ্চিত।

 

এছাড়া শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপ, এই তিন দেশেরই চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। তবে তারা ভারতকেও প্রধান অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে তাদের সাড়া নির্ভর করবে দুই শক্তির প্রভাব-সমীকরণে কে বেশি সুবিধা দিতে পারে তার ওপর।
 
সার্কের বাকি দুই সদস্য রাষ্ট্র ভুটান ও আফগানিস্তান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে দ্রুত কোনো অবস্থান নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
 
ভারত কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে?
এই উদ্যোগকে ভারত সম্ভবত তার আঞ্চলিক প্রভাব দুর্বল করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখবে। নয়াদিল্লি ইতিমধ্যে বিমসটেক, আইওআরএ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের মাধ্যমে বিকল্প আঞ্চলিক ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলেছে; যেখানে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই নতুন পাকিস্তান–চীন–বাংলাদেশকেন্দ্রিক ব্লকের জবাব হিসেবে ভারত তার বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মগুলো আরও সক্রিয় করতে পারে। এ ছাড়া ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোকে অর্থনীতি, অবকাঠামো ও বাণিজ্যে বিকল্প সুবিধা দিয়ে তাদের পাশে রাখার চেষ্টা জোরদার করতে পারে।

 

পাকিস্তানের প্রস্তাবটি দক্ষিণ এশীয় কূটনীতিতে একটি নতুন আলোচনা-দরজা খুলেছে—এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। সার্ক বহু বছর ধরে স্থবির, আর অঞ্চলে নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে। ফলে এই উদ্যোগ প্রভাব বিস্তারের নতুন মাঠ তৈরি করতে পারে। তবে এটিকে বাস্তবে সফল করতে প্রয়োজন—একাধিক দেশের সক্রিয় সমর্থন, ভারতকে এড়িয়ে নয় তাকে সহই বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার সক্ষমতা, ভূরাজনীতি নয়, বাস্তব বাণিজ্য-সংযোগ-উন্নয়ন সুবিধা প্রদর্শন। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে প্রস্তাবটি আগের অনেক আঞ্চলিক উদ্যোগের মতো কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।

 

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা