Image description
 

নেপালে দুর্নীতি ও সামাজিকমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল সহিংসতায়। এর জেরে গত ৯ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। আগুনে পোড়ে কাঠমান্ডুর সিংহ দরবার। ১১৭ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক এই ভবনেই ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

অগ্নিসংযোগ হয় পার্লামেন্ট ভবনসহ একাধিক ফেডারেল দপ্তর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। কারাগারের তালা ভেঙে বন্দি পালানোর ঘটনাও ঘটে।

 

৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে ১৯ বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার পর জনরোষ আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল তরুণ ছাত্র। প্রতিবাদের মুখে পুলিশ সরতে শুরু করলে দেশজুড়ে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ১০ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনী।

দু’দিন পর রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। তার প্রধান উপদেষ্টা অজয় ভদ্র খানাল জানিয়েছেন, তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন। ভোটের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে আগামী ৫ মার্চ।

 

রাজধানীতে নীরব উত্তেজনা

তিন মাস পর কাঠমান্ডুতে স্বাভাবিকতা ফিরলেও ভেতরে ভেতরে চলছে হতাশা আর উত্তেজনা। একদিকে আশা—নতুন নেতৃত্ব হয়তো দুর্নীতি, বেকারত্বসহ দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে আসবে। অন্যদিকে ভয়—নিরাপত্তাজনিত কারণে বা বড় দলগুলোর বয়কটের ফলে নির্বাচন পিছিয়ে গেলে আবার সহিংসতা দেখা দিতে পারে।

নেপালের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ বহুদিন ধরে তিন প্রবীণ নেতার হাতে—৭৯ বছরের শের বাহাদুর দেউবা (নেপালি কংগ্রেস), ৭১ বছরের পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ড (মাওবাদী) ও ৭৩ বছরের কেপি শর্মা ওলি (কমিউনিস্ট)। ২০১৫ সালের সংবিধানের পর থেকে সরকার বদলেছে সাতবার। ক্ষমতা ধরে রাখতে তিন নেতাই জোট রাজনীতির ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলায় অভ্যস্ত।

তবে সাম্প্রতিক আন্দোলন এই পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ওলি এখনো ক্ষমতায় ফেরার দাবি জানাচ্ছেন। মাওবাদীরা সংস্কারের দাবি করলেও তাদের তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। নেপালি কংগ্রেসও অভ্যন্তরীণ বিরোধে দুর্বল। তা সত্ত্বেও নির্বাচনী নিবন্ধনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসতেই তিন দলই ভোটে অংশ নিতে সম্মত হয়েছে।

  

রাজনীতির মাঠে তরুণ আন্দোলনকারীরা

সেপ্টেম্বরের সেই আন্দোলনে সামনে থাকা তরুণদের অনেকেই এখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন। আহত বিক্ষোভকারীকে উদ্ধার করে ভাইরাল হওয়া কিশোরী কার্কির দলের নিবন্ধনের খবর আন্দোলনকারীদের আরও উজ্জীবিত করেছে। আরেক তরুণ প্রাদীপ জিওয়ালি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। তরুণদের এই উত্থান নেপালের রাজনীতিতে নতুন শক্তি সঞ্চার করছে।

এদিকে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও উৎসাহ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের পর থেকে নতুন ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার মানুষ।

ভারত-চীনের সংকেত: চাই স্থিতিশীল নেপাল

নেপালের সবচেয়ে বড় দুই প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারত ও চীন–দু’দেশই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভারত প্রধান দলগুলোকে ভোটে অংশ নিতে চাপ দিচ্ছে এবং নিরাপত্তা ও লজিস্টিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীনও সীমান্ত এলাকায় অস্থিতিশীলতা এড়াতে দ্রুত নির্বাচন চায়। পশ্চিমা দেশগুলো প্রকাশ্যে না বললেও নীরবে নির্বাচনকে সমর্থন করছে।

 

দুর্নীতি, বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ

নেপালের ভোটারদের প্রধান উদ্বেগ দুর্নীতি। কিন্তু এরও গভীরে রয়েছে বিশাল অনিশ্চয়তা। দেশটির মধ্যম বয়স মাত্র ২৬ বছর, অথচ যুবসমাজের এক-পঞ্চমাংশ বেকার। মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার, যা ভারতের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ হলেও কমপক্ষে ২২ লাখ নেপালি কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্রম দিচ্ছেন তারা।

তরুণ উপদেষ্টা প্রাদীপ জিওয়ালি বলেছেন, আমার অনেক বন্ধু বিদেশে। তারা আমাকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি থাকতে চাই, দেশের জন্য কাজ করতে চাই।

 

নেপালের সামনে আপাতত দুটি পথ খোলা—নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা গড়ে দিয়ে দেশকে স্থিতিশীল করা, অথবা পুরোনো শাসকগোষ্ঠীর অস্থিরতায় আবারও অরাজকতার উত্থান। দেশটির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে আসন্ন নির্বাচনের ওপর।